মতামত

আর কত দিন কল্পনা বিলাস?

কেউ বলছেন-
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়”। আবার কেউ বলছেন,
এই মৃত্যু মিছিল আর দেখতে চাই না। কিন্তু কতটা প্রত্যয় নিয়ে আমরা একথা বলছি, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। শহরে বা আধা শহরে বসে মৃত্যু মিছিলের খবর শোনা বা জানা আর রক্তস্নাত গ্রামবাংলায় মৃতের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে, তাকে প্রত্যক্ষ করবার অভিজ্ঞতা শুধু এক নয় বললে সত্যিই বড্ড কম বলা হয়। এমনই একটা দুঃসহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেখানে মৃতদেহ একটা সংখ্যাও নয়। কখনো তা দিনের আলোর মধ্যে পঞ্চাশ, আবার কখনো অন্ধকারের ঘেরাটোপে তা কমে গিয়ে ঊনিশ। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে তফাৎ নেহাতই ঊনিশ-বিশ, একে গরীব মানুষ তার ওপর নির্বাচনের সেলের বাজার, সেখানে জীবন তো মূল্যহীন। সত্য-অসত্যের কচকচি যদি ছেড়েও দিই, তথ্যের অধিকার বলে একটা সংবিধান স্বীকৃত আইন তো আছে। রাষ্ট্র যখন পঞ্চাশকে সতেরো বলে চালায়, তখন সমস্ত নির্লজ্জতাও যেমন লজ্জা পায়, তেমনি গণতন্ত্রের অসাড়তা বেআব্রু হয়ে পড়ে। কিন্তু সত্যিই অন্য কিছু কি প্রত্যাশিত ছিল? নাকি কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? ১০-১২ টা লাশ হলে ‘ঠিক’ ছিল??

আসলে গ্রামবাংলার দখল কার, এই প্রশ্নে যখন সান্ধ্য বাজার গরম করে তোলা হয়, তখন গ্রামবাংলার দায়িত্ব কার, এই মৌলিক প্রশ্নটিকেই গলা টিপে হত্যা করা হয়। দখলদারির যুদ্ধ দেখতে দেখতে সুশিক্ষিত জনসমাজের আর মনে থাকে না, ভারতবর্ষ বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে তার গ্রামে।

গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রকরণগুলিকে কোনো রকম গুরুত্ব না দিয়ে, গ্রামসংসদ, গ্রামসভা – এই জাতীয় আদানপ্রদানের পরিসরগুলোকে ধ্বংস করে শুধুমাত্র দলীয় আনুগত্যের নিরিখে, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নকে দেখতে চাইলে যা অচিরেই জন্ম নেয় তা একক বা গোষ্ঠীগত একাধিপত্য বা দখলদারি, সম্মিলিত দায়িত্ববোধ নয়।

এই দখলদারি যতদিন শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সমার্থক ছিল, ততদিন তা গ্রামীণ জীবনে একধরনের ঘাত-প্রতিঘাতকে প্রতিফলিত করত, কিন্তু যখন এই দখলদারির সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব যুক্ত হয়ে পড়ল, তখন তা লাগামছাড়া দূর্নীতি ও ভয়াবহ বৈষম্যের জন্ম দিল। এই নিদারুণ বৈষম্য ও তীব্রতম স্বার্থের দ্বন্দ্বের মধ্যেই আজকের রক্তাক্ত পরিস্থিতির বীজ নিহিত।

কেমন হবে গ্রাম, কী হবে তার উন্নয়নের অভিমুখ, কিভাবে হবে তার যথাযথ পরিকল্পনা, কী হবে গ্রাম শহরের আন্ত-সম্পর্ক, কোন কোন স্থানীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে উন্নয়ন এর স্তর ঠিক হবে, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কর্ম সংস্থান এর সম্পর্ক কী হবে- এসব প্রশ্নগুলো কে অর্থহীন করে রেখে নির্বাচন হলে দখল ছাড়া আর কীই বা পড়ে থাকে? এর বদল ঘটানোর মতো উপযুক্ত সার্বিক উদ্যোগই বা কতটুকু? তাই যা ঘটছে তার বাইরে আরও অন্য কিছু ঘটবার ছিল কি?

শুধু নির্বাচনের আগে পরে সরকারি নিস্পৃহতা নয়, প্রশাসনিক উদাসীনতা নয়, নির্বাচন কমিশন নামক প্রহসন নয় – গ্রামীণ উন্নয়ন তথা গ্রামের মানুষজনের জীবন সম্পর্কে সমস্ত সময়ে যে চরম ঔদাসীন্য ও ভ্রান্ত সরকারি পরিকল্পনা কাজ করে তাই এই রকম অরাজক রক্তস্নাত পরিস্থিতির জন্ম দেয়, একবার নয়, বারবার।

অভিজিৎ চন্দ
অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়