। । মুহম্মদ জাফর ইকবাল । ।
পৃথিবীতে যেসব বিচিত্র বিষয় নিয়ে ব্যবসা হয় আমার ধারণা, তার একটি হচ্ছে তথ্য-উপাত্তের ব্যবসা। ইংরেজিতে আজকাল খুব সহজে যেটাকে আমরা বলি ‘ডাটা’। এটা যদি ছোটখাটো একটা ব্যবসা হতো, তাহলে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না; কিন্তু এটা মোটেও ছোটখাটো ব্যবসা না। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসাগুলোর একটি। শুনেও ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না, তথ্য-উপাত্তের ব্যবসা নাকি পৃথিবীর তেল-গ্যাসের ব্যবসার মতো বড় ব্যবসা!
প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্য-উপাত্ত বলতে আমরা ঠিক কী বোঝাই? এটা নিয়ে আবার ব্যবসা হয় কেমন করে? আমি যেভাবে বুঝি সেটা এ রকম, ‘আমি’ মানুষটাকে নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে চাইবে না। মানুষ হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্রণা। মানুষের যদি মূল্য থাকত, তাহলে আমাদের দেশের দশ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে পৃথিবীতে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকো বর্ডারে একটা দেয়াল তোলার জন্য এত ব্যস্ত হতেন না। ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীরা এভাবে ডুবে মারা যেত না। মানুষের কোনো ব্যবসা-মূল্য না থাকলেও মানুষের তথ্য-উপাত্ত বিশাল মূল্যবান জিনিস। আমাকে নিয়ে কেউ টানাটানি করবে না; কিন্তু আমি কী খাই, কী পরি, কী পড়ি, কোথায় থাকি, আমার বন্ধু-বান্ধব কারা, আমি কোন সিনেমা দেখতে পছন্দ করি, আমার প্রিয় চিত্রতারকা কে- এই তথ্যগুলো বিশাল মূল্যবান জিনিস। শুধু আমার একার এই তথ্য-উপাত্ত হয়তো খুব বেশি মূল্যবান নয়। কিন্তু সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের তথ্য-উপাত্ত একসঙ্গে পেয়ে গেলে তার মূল্য অবিশ্বাস্য। সেগুলো দিয়ে পৃথিবীকে ওলটপালট করে ফেলা যায়। জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আজকাল সোজাসুজি বলতে শুরু করেছেন, যে সবচেয়ে বেশি তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করতে পারবে, সে এখন এই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা কি আমাদের দেশেও এই বিষয়গুলো দেখতে শুরু করিনি? একজন রাজনৈতিক নেতা যখন আন্দোলন চাঙ্গা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লাশ ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন, টেলিফোনে তার কথাবার্তা সময়মতো ফাঁস হয়ে যায়। ছাত্রলীগ যখন কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে, সেই কথাবার্তাও ফাঁস হয়ে যায়! কেউ না কেউ তথ্যগুলো যত্ন করে রক্ষা করে, সময়মতো ব্যবহার করে। কাউকে ঘায়েল করার জন্য এর থেকে বড় অস্ত্র আর নেই!
আমরা সবাই নিশ্চয় লক্ষ্য করেছি, তথ্য-উপাত্তগুলো আমাদের ওপরেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি যখন গুগলে কোনো কিছু খুঁজতে চাই, শব্দটা টাইপ করার আগেই গুগল সেটা আমাকে বলে দেয়। তার কারণ আমি কোন ধরনের তথ্য খুঁজতে চাই, গুগল সেটা আমার থেকে ভালো করে জানে। আমাজনে আমি যখন বই ঘাঁটাঘাঁটি করি, আমি কিছু করার আগেই তারা আমার পছন্দের বইগুলো দেখাতে শুরু করে। আমার পছন্দ-অপছন্দ সব তারা এর মাঝে জেনে গেছে। ইউটিউবে গান শুনতে চাইলেই তারা আমার সামনে একটার পর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হাজির করতে থাকে! এ রকম উদাহরণের কোনো শেষ নেই এবং আমরা যারা নানা কাজে নেট ব্যবহার করি, তারা এটা নিয়ে কোনো আপত্তি করিনি বরং বলা যায়, বিষয়টা হয়তো উপভোগই করেছি।
কিন্তু এই একেবারে নির্দোষ সাহায্যের ব্যাপারটি যে ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র হয়ে যেতে পারে; পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যেতে পারে, সেটা কি সবাই জানে? ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে একজন চরম অমার্জিত ব্যবসায়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়ার কারণে যে পুরো পৃথিবীটা একটা অবিশ্বাস্য রকমের বিপজ্জনক জায়গা হয়ে গেছে, সেটি কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? তার নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে অনেক ভিন্ন। তার খুঁটিনাটিতে না গিয়ে খুব সহজভাবে বলা যায়, নির্বাচনের আগেই খুঁজে বের করে ফেলা হলো, কোন স্টেটে কতজন মানুষকে নিজেদের দিকে টেনে নিতে পারলে নির্বাচনে জিতে যাওয়া যাবে। এই অংশটুকু সহজ; কিন্তু নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে নিজের দিকে টেনে নেওয়া এত সহজ না। তবে ব্যাপারটা সহজ হতে পারে, যদি কেউ প্রত্যেক ভোটারের চিন্তার ধরন ও পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো আগে থেকে জেনে যায়। যারা আগে থেকেই নিজের দলে আছে, তাদের পেছনে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। যাদের কোনোভাবেই নিজের দিকে টেনে নেওয়া যাবে না, তাদের পেছনেও সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। এই দুই দলের মাঝখানে যারা দোদুল্যমান, তাদের পেছনে সময় দেওয়া হলে কাউকে কাউকে নিজের দিকে টেনে নেওয়া যাবে। কাজটা খুব সহজ, যদি মানুষগুলো সম্পর্কে আমি জানি। সবাইকে একভাবে প্ররোচিত না করে যে যেভাবে কথা শুনতে চায়, তাকে সেভাবে কথা শুনিয়ে মুগ্ধ করতে হবে।
আমেরিকার নির্বাচনে ঠিক এই কাজটা করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় আমেরিকার প্রত্যেক ভোটারের প্রায় পাঁচ হাজার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন পরিচালনা টিম জেনে গিয়েছিল। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামে একটা তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। তারা তথ্যগুলো পেয়েছিল ফেসবুকের কাছ থেকে। যারা ফেসবুক ব্যবহার করে, তারা সেখানে কী লেখে, সেখান থেকে কী পড়ে, ফেসবুক সবকিছু জানে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে সেগুলো একটুখানি বিশ্নেষণ করলেই প্রত্যেক মানুষের নাড়ির খবর বের করে ফেলা যায়। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা যে পদ্ধতিতে ফেসবুকের কাছ থেকে প্রত্যেক ভোটারের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো এবং আলাদা আলাদাভাবে তাদের মনমানসিকতা, চিন্তার পদ্ধতি বের করে নিয়ে এসেছিল, সেটি আইনসম্মত ছিল না। সেটা যখন জানাজানি হয়েছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এর মাঝে প্রতিদিন ফেসবুকে এক মিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপন দিয়ে ঠিক যে কয়জন মানুষকে প্রভাবিত করে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলা যাবে, সেটা করে ফেলা হয়েছে। তারা যে ভাষায় যে কথা শুনতে পছন্দ করে, তাদের ঠিক সেই ভাষায় সেই কথা শোনানো হয়েছে। তার ফলাফল আমরা সবাই জানি। সারা পৃথিবীর সব মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে একদিন আবিস্কার করেছে, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট একজন রুচিহীন, অমার্জিত, অশালীন ব্যবসায়ী। শুধু আমেরিকার নির্বাচন নয়, এই মুহূর্তে যে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্য তছনছ হয়ে যাচ্ছে, প্রচলিত ভাষায় আমরা যেটাকে ব্রেক্সিট বলি, সেটাও ঠিক একই কায়দায় একইভাবে করা হয়েছিল। সেটার দায়িত্বটুকুও নিয়েছিল ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামে তথ্যপ্রযুক্তির সেই নীতিবিবর্জিত কোম্পানি।
অনেকেই হয়তো জানে, এক-দু’জন মানুষের আদর্শবাদী প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে শেষ পর্যন্ত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের চোখের সামনে এসেছে। শেষ পর্যন্ত ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে কোম্পানিটা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে। ফেসবুকের কিছু হয়নি; সেটা বহাল তবিয়তে পৃথিবীর সব মানুষের সব তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ গদগদ হয়ে সব তথ্য তাদের হাতে তুলে দিয়ে কৃতার্থ হয়ে যাচ্ছে। তারা জানেও না, এসব বড় তথ্যপ্রযুক্তির দানবদের সামনে তারা একজন উলঙ্গ মানুষের মতো। কারণ তাদের কোনো কিছুই এই দানবদের কাছে অজানা নেই! ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু যে প্রবল প্রতাপে আছেন তা নয়, সামনের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন!
সাধারণ মানুষের কোনো ধরনের মাথাব্যথা না থাকলেও যারা বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তারা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। তাদের অনেকের ধারণা, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ বলে যে বিষয়টি আমরা এতদিন জেনে এসেছি, পৃথিবীতে সেটি আর ঘটবে না! আমরা হয়তো তার প্রমাণও দেখতে শুরু করেছি। সারা পৃথিবীতে যেভাবে ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান হতে শুরু করেছে, সেটি কি স্বাভাবিক ঘটনা? আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মনে হচ্ছে, সেগুলো কি আসলেই তাই?
যেহেতু আমাদের তথ্য দিয়েই আমাদের ঘোল খাওয়ানো হচ্ছে; তাই নিজের তথ্যকে রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবীতেই ধীরে ধীরে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হতে শুরু করেছে। মানুষকে বোঝানো শুরু হয়েছে যে, ‘তোমার তথ্যটি আসলে শুধু তথ্য নয়, সেটি হচ্ছে সম্পদ। এই সম্পদের মালিক তুমি। এই সম্পদটি তুমি রক্ষা করো।’ আমি যদি লুটপাট কিংবা ডাকাতি করার জন্য আমার ঘরের দরজা ডাকাতদের জন্য খুলে না দিই, তাহলে কেন ডিজিটাল সন্ত্রাসীদের জন্য আমার নিজের সমস্ত তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেব? (ডিজিটাল সন্ত্রাসী শব্দটা আমার বানানো শব্দ নয়। আকজাল অনেক সময় এই শব্দটা ব্যবহার করা হয়। আমার ধারণা, এটি একটি যথার্থ শব্দ)।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কও একটি নতুন বিষয়। আমাদের চোখের সামনে দেখতে দেখতে এটি সারা পৃথিবীকে দখল করে নিতে শুরু করেছে! যারা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, তাদের যদি এটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে তারা গলা কাঁপিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলবে, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আমাদের সবাইকে একের সঙ্গে অন্যকে যুক্ত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর দিকে যদি তাকাই, তাহলে আমরা কিন্তু পুরো উল্টো বিষয়টা দেখব। মনে হচ্ছে, এটা পৃথিবীটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে (এটি আমার নিজের কথা নয়, এটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চিন্তাভাবনা করে বলা কথা)। তবে কথাটি সত্যি নাকি বানোয়াট, আমরা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখতে পারি। দশ লাখ রোহিঙ্গার ওপর গণহত্যা চালিয়ে তাদের আমাদের দেশে পাঠানোর আগে দীর্ঘদিন মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের সঙ্গে তাদের একটি দূরত্ব তৈরি করা হয়েছিল। শুধু বিভেদ নয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটা ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা তৈরি করা হয়েছিল। কেমন করে এত সহজে কাজটি করা হয়েছিল? আমরা খোঁজ নিলেই দেখতে পাব, সেটা করা হয়েছিল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। আমাদের দেশের উদাহরণও যদি নিই, আমরা ঠিক একই ব্যাপার দেখব। এখানে রামু কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই ভিন্ন ধর্মের ওপর আঘাতের বিষয়টি করা হয়েছিল ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। পৃথিবীতে এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আরও একজন মানবতাবিরোধী রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। এই মানুষটিও মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে নির্বাচনে জিতে এসেছেন এবং সবাই জানে, এর জন্য এই মানুষটি ব্যাপকভাবে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেছে। এ রকম উদাহরণের কোনো অভাব নেই এবং শেষ পর্যন্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর ভেতর এগুলো বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে। তারা বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের মাঝে বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করেছে। সেদিন খবরে দেখেছি, মানুষের মাঝে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! এগুলো একান্তই লোক দেখানো কাজ, করা হচ্ছে অনেক দেরি করে, অনেক ছোট পরিসরে। দুধ-কলা খাইয়ে একবার একটা দানব তৈরি করে ফেললে পরে মাথায় হাত বুলিয়েও তাকে শান্ত করা যায় না।
২.
বলা যেতে পারে, এই লেখাটির ওপরের অংশটি হচ্ছে ভূমিকা। এখন আমি আমার মূল বক্তব্য বলতে চাইছি। পৃথিবীটাতে যে তথ্য নিয়ে একটা হুলস্থূল কর্মকাণ্ড ঘটছে, সেটা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরেছেন। আগে যে রকম একটি দেশ অন্য দেশকে কলোনি করে ফেলত, এখন সেটার একটা নতুন রূপ হয়েছে; সেটা হচ্ছে ‘ডাটা কলোনি’। এখানে বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তির দানব আমাদের দেওয়া তথ্য ব্যবহার করে তাদের তথ্যপ্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করছে এবং আমরা বুঝে হোক না বুঝে হোক, সেই বড় বড় দানবের তৈরি করা কলোনির অধিবাসী হয়ে আছি। কলোনির অধিবাসীর এক ধরনের মানসিকতা থাকে, এক ধরনের হীনমন্যতা থাকে; আমাদের ভেতরে ঠিক সেটা ঘটে গেছে। আমরা নিজেরা কিছু করি না। করা যেতে পারে, আমাদের সেই ক্ষমতা আছে- সেটাও বিশ্বাস করি না। সবসময়ই বড় বড় ডিজিটাল দানবের মুখ চেয়ে থাকি। তাদের সেবা গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়ে যাই। আমরা মনে করি, তারা আমাদের বিনামূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যাপারটা যে ঠিক তার উল্টো, সেটা বুঝতে চাই না!
যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, সেটি ছিল এই দেশের জন্য অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। আমার মনে আছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে ঠিক কী বোঝানো হয়েছিল, দেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রথমে সেটা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি; কিন্তু তাতে সমস্যা হয়নি। ধীরে ধীরে সবাই সেটা বুঝতে পেরেছে। অনেক কিছু হয়েছে, যেটা এমনিতে হতো না।
আমি মনে করি, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী পর্যায়ে পা দেওয়ার সময় হয়েছে, যেখানে আমরা অন্যদের তৈরি করে দেওয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তুষ্ট থাকব না; নিজেরা নিজেদের প্রযুক্তি তৈরি করে নেব। এই মুহূর্তে আমরা হয়তো মেট্রোরেল তৈরি করতে পারব না। চন্দ্রযান তৈরি করতে পারব না; কিন্তু অবশ্যই নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন, নিজেদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারব। তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তা একটি অনেক বড় বিষয়। পৃথিবীর সব দেশ এখন সেই নিরাপত্তার জন্য তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করতে শুরু করেছে। আমরা এখনও বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে আছি। পৃথিবীতে যে তথ্যপ্রযুক্তির একটা বিশাল বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে, তার পেছনে যে মূল চালিকাশক্তি সেটি হচ্ছে- ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। আমরা সেটা মাত্র ব্যবহার শুরু করেছি; কিন্তু এই জ্ঞানটুকুর নিজস্ব রূপ আমাদের নেই। এ মাসের শেষে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কম্পিউটারায়নের ওপর একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হচ্ছে। গত বছরের মতো এ বছরও সারা পৃথিবী থেকে বাংলা ভাষার বড় বড় গবেষক আসছেন; অনেক পেপার জমা পড়েছে, সেখান থেকে বেছে বেছে গোটা ত্রিশেক পেপার উপস্থাপন করা হবে। আমি সেগুলোর ওপর চোখ বুলিয়েছি। প্রায় সব পেপার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে গবেষণা। তারপরও আমি ভেতরে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমরা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচ্ছি, কখন আমরা নিজেরা প্রযুক্তি তৈরি করব?
আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এই দেশে এখন আমাদের মানবসম্পদ আছে। এই দেশে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ নেই বলে তারা বিদেশে পাড়ি দেয়। সেখানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে। আমরা কি আমাদের দেশে গবেষণার একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি না? যেখানে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কাজ করবে, বিলিয়ন ডলার কোম্পানি তৈরি করার জন্য নয়, দেশকে ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য। আমরা অতীতে কলোনি হয়ে থেকেছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন আর কখনও কলোনি হতে না হয়। অন্যের কলোনি হয়ে বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের, অনেক লজ্জার! ডিজিটাল বাংলাদেশের দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা এখন পা দিতে চাই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।