।। জয়নন্দন হালদার। ব্যাঙ্কক, ৭/১১/১৯. রাত ১১.৪০ ।।
কয়েকমাস আগে থেকে নবনীতা পিসিকে হোয়াটসঅ্যাপে তাগাদা দিয়ে আসছিলাম “পিসি, বাবাকে যেভাবে দেখেছো একটু লিখে পাঠাও।”
প্রায়ই বলতেন, “দাঁড়া লিখছি, বিদেশ থেকে ফিরেই লিখছি।” এই আজকের ভয়েই তাড়া দিতাম। বাবাকে যাঁরা সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত, পিসি তাঁদের একজন।
গত তিন চার বছর ধরে বাবার (নিরঞ্জন হালদার) যাঁরা আনন্দবাজারের সহকর্মী ছিলেন, তাঁরা এক এক করে বিদায় নিচ্ছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নিখিল সরকার- আরও আনেকেই। এরা সব এক ঘরেই বসতেন। বাকি ছিলেন নবনীতা দেব সেন। এখন বাবাকে উল্টে বলতে হবে, “বাবা, নবনীতা পিসির উপর একটা লেখা লেখ।”
বাবা, নবনীতা পিসি, অমর্ত্য সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন ডিভোর্সড আর সিঙ্গেল ফাদার! নবনীতা পিসিও ছিলেন ডিভোর্সড আর সিঙ্গেল মাদার। তাঁর দুই কন্যার সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক দুই বছর করে। নন্দনা দুবছরের ছোট আর অন্তরা দুই বছরের বড়। বাবা পিসির বাড়ি প্রায়ই রেখে আসতেন আমাকে। আমার মা ছিলেন থাই। বাবা রাধারানী দেবীর( নবনীতা দেব সেনের মা) কাছে নাকি প্রায়ই মা-কেও রেখে আসতেন। শুনেছি নবনীতা পিসি আর ‘দিম্মা’ রাধারানী দেবী মাকে খুব ভালোবাসতেন।
ছোটবেলা থেকেই হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে যাওয়া আসা। আমার ছোটাছুটি দোতলা থেকে তিনতলা। ছাদেও চলে যেতাম। প্রথম প্রথম যখন যেতাম একটু ভয় করতাম পিসিকে। মাঝেমাঝেই দেখতাম পিসি টেলিফোনে কাউকে না কাউকে চেঁচিয়ে ধমক দিচ্ছেন। নবনীতা পিসির বাড়ি যখন প্রথম যাই সবথেকে শান্তির জায়গা ছিল দোতলার বাথরুম। বাথরুম নয়, যেন শৌখিন বেডরুম। আর বাথরুমের তাকে থাকত বই। এইজন্যই আমাকে আরো টানত ওই বাড়ি।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। তিন-চার বছর বয়সে যখন থাইল্যান্ড থেকে বাবা আমাকে এই দেশে নিয়ে চলে আসেন তারপর সেই ক্লাস সিক্সের আগে আর মা-কে দেখিনি। বাবা একদিন হঠাৎ ব্যঙ্ককের প্লেনের টিকিট নিয়ে এলেন, বললেন নবনীতা পিসি প্লেনের টিকিটের পয়সা দিয়েছেন- আমি যাতে মা-কে দেখতে যেতে পারি। পিসি ছিলেন দুই কন্যার মা। তাঁর মনে হয়েছিল আমার সঙ্গে মায়ের একবার দেখা হওয়া উচিত। পরে যখন বোঝার ক্ষমতা হল, বুঝলাম কত গভীর মানবিকতার মানুষ ছিলেন। তাঁকে তো রাগী বলেই দেখে এসেছি।
একবার ছোট কন্যার (নন্দনা দেব সেন) সঙ্গে পৌষমেলায় শান্তিনিকেতন গেলাম। উঠেছিলাম অমর্ত্য সেনের মা’র কাছে। অমীতা সেন একদিন বললেন অমর্ত্য আসছে, আমাকে হয়ত ডঃ অম্লান দত্ত-র বাড়ি থাকতে হবে (সেই সময়ের Vice Chancellor)। আমার তখন প্রথম শান্তিনিকেতন যাত্রা, পকেটে ফুটো কড়ি। বাধ্য হয়ে অম্লান জেঠুর বাড়ি রাতের বেলা যেতে হল, বকুনিও খেয়েছিলাম অম্লান জেঠুর কাছে। পরের দিন নাকি নবনীতা পিসি আমার হয়ে বেধরক ঝগড়া করেছিলেন অমর্ত্য সেনের মা অমীতা সেনের সঙ্গে যে একটা ছোট ছেলেকে কিভাবে রাতের বেলা অন্যের বাড়ি থাকতে পাঠানো হয়। রাধারানী দেবীও ফোন তুলে অমীতা সেনকে কড়া ধমক দিয়েছিলেন। এতটাই ভালোবাসতেন ওঁরা আমাকে ।
একবার বললেন, ” বাবুই বলতো তোর বাবা সবার সঙ্গে কেন ঝগড়া করে বেড়ায়? “- বাবার কাছে রোজ পেটানি খাবার পরেও বাবার সম্পর্কে বলায় ভেতরে একটা ফুলকির মত আগুন জ্বলে উঠেছিল। বললাম ” তুমিও তো সারাদিন সবাইকে বকো, কানাইদাকে বকছো, দিম্মার সাথে ঝগড়া করছো, অভীক সরকারের সাথে ঝগড়া করছ! ” নবনীতা পিসি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন। এখন ভাবি সেদিন কি করে এত সাহস পেয়েছিলাম!
আমি কর্মজীবনে অনেকবার চাকরি ছেড়েছি। আর তার ফল হিসাবে আমার বাবাকে টাকা পাঠাতেও পারতাম না। একদিন আমাকে খুব বকলেন। সেদিন কিছু বলিনি। ব্যঙ্কক ফিরে পাঁচ পাতার একটা চিঠি লিখেছিলাম। বেশ কড়া ছিল চিঠিটা। বলেছিলাম না জেনেশুনে কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। বড় মেয়ে অন্তরা তারপর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু নবনীতা পিসি দুই মাস আগে পর্যন্ত সমানে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন ধরনের কথা আলোচনা করেছেন। বাবার খবর নিয়েছেন, ফোনে কথা বলেছেন ক্যানসার ধরা পড়ার পরও। সেপ্টেম্বরে কলকাতা গিয়েছিলাম দুই দিনের জন্য, ভেবেছিলাম ডিসেম্বরে এসে দেখা করবো।
মাঝে মাঝে থাই পল্লীগীতি পাঠাতাম, বলতেন তাঁর নাকি সুরগুলো খুব ভালো লেগেছে। “JOB2DO” বলে একটা থাই সঙ্গীতদলের গান পিসির খুব ভালো লাগত। সেগুলো ছিল সমুদ্রের গান, মাটির গান, জেলেদের গান। সেই গানগুলোর একটা সরল মানে থাকত। একটা অসম্ভব সুন্দর হাওয়ার মত সুর থাকত, ঠিক যেমনটি সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া মুখের উপর দিয়ে চলে যাবার সময় চোখ বুজিয়ে দেয়, তেমনি সেই চোখ বোজানো সুন্দর হাওয়ার মতোই আজ পিসি চোখ বুজলেন।
মনে হল আমি আমার মা’কে হারালাম। আমার বিয়েতেও তুমি সাক্ষী ছিলে। ‘নবনীতা পিসি’ বলে হয়তো তোমাকে ডাকতাম কিন্তু তুমি আমার মা ছিলে। আজ মাকে হারালাম। কত স্মৃতি মনে আসছে। একদিন অমর্ত্য কাকু তোমাকে আমাকে টুম্পা আর পিকুদিকে বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে নিয়ে গেলেন তোমার সেই ফিয়েট গাড়িতে করে। তুমি গাড়ি চালিয়েছিলে সারাদিন। ফেরার পথে আমরা সবাই লেক মার্কেটে একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম। খাবার সময় অমর্ত্য কাকু টুম্পা কে সেখালেন কিভাবে কাটা চামচে খেতে হায়।
৭২ হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির দরজা আজ আমার কাছে বন্ধ হয়ে গেল চিরদিনের মত। দিম্মা নেই, তুমিও চলে গেলে, আমি প্রকৃত অর্থেই নিঃস্ব হলাম। তুমি সকলের কাছে বেঁচে থাকবে তোমার সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে আর আমার মনের ভেতর সেই ছেলেবেলার মা হয়েই থাকবে। ভাল থেকো পিসি……
লেখক ব্যাঙ্ককে কর্মরত। নবনীতা দেব সেনের দুই মেয়ের বাল্যবন্ধু