সালটা ১৯৪০। কালিম্পং-এ তখন পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী। শরীর সায় দিচ্ছে না। তবু পাহাড়ের প্রকৃতির টানে আর পুত্রবধূকে দেখার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে কালিম্পং গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু, বেশিদিন কালিম্পং-এর জলহাওয়া সহ্য হল না কবিগুরুর। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দার্জিলিং থেকে এলেন সিভিল সার্জেন। কবিগুরুর শারীরিক পরীক্ষা করে মত দিলেন অবিলম্বের অস্ত্রোপচারের। একটু সুস্থ হতেই কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হল কবিগুরুকে। সুস্থ শরীর নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ফিরলেন অসুস্থ হয়ে।
১৯১৬ সাল থেকে কবির চিকিৎসা করছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার। তিনি কোনও দিনই কবির অস্ত্রোপচারের পক্ষে ছিলেন না। যখন কবি গুরুতর অসুস্থ হলেন তখন গিরিডি-তে নীলরতন সরকার। রবীন্দ্রনাথের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখলেন বিখ্যাত চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়। তিনিও সায় দিলেন অস্ত্রোপচারের।
শরীর জুড়ে প্রবল অস্থিরতায় লিখে চলেছেন জীবনের শেষ অধ্যায়। যা ফুটে উঠছে ‘রোগশয্যা’, ‘আরোগ্য’, ‘জন্মদিন’-এর মতো রচনায়। কলকাতা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ট্রেনে করে শান্তিনিকেতনে আনা হল কবিগুরুকে। সেখানে তখন এক বিষাদের ছায়া।
জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে দোতালার পাথরের ঘরের পূবদিকের বারান্দায় তৈরি করা হল অস্থায়ী অপারেশন থিয়েটার।
অস্ত্রোপচারের পরও সুস্থ হলেন না কবি। আরও বেড়ে গেল শারীরিক অসুবিধা। আচ্ছন্নভাবটা আরও মাত্রা ছাড়া হল। অবেশেষে খবর পৌঁছল গিরিডিতে। উদ্বিগ্ন চিত্তে তাড়াতাড়ি কলকাতায় এলেন ডক্টর নীলরতন সরকার। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে সোজা চলে গেলেন কবির কক্ষে। পরম মমতায় কবির কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।
৭ অগস্ট। সকাল ৯টায় কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হল। শেষবারের মতো তাঁকে দেখে গেলেন চিকিৎসক বিধান রায়, ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির অক্সিজেনের নল একটু পরে খুলে দেওয়া হল। ধীরে ধীরে কমে আসছিল কবির পায়ের উষ্ণতা। ১২টা ১০ মিনিটে পুরোপুরি থেমে গেল হৃদস্পন্দন।
১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট, বাংলা ক্যালেন্ডারে দিনটা ছিল ১৩৪৮ সনের ২২-শে শ্রাবণ। ফুলে-ফুলে সজ্জিত কবিগুরু তখন চিরঘুমে শায়িত। জোড়াসাঁকোয় তিল ধারণের জায়গা নেই। বাইরেও অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকলেই কবিগুরুকে শেষবারের জন্য কাঁধে নিতে চান। প্রকৃতির কোলে শান্তিনিকেতনেই নিজের নশ্বর দেহটার বিলীন চেয়েছিলেন কবি। কিন্তু সে সাধ আর পূরণ হয়নি। কলকাতায় নিমতলা মহাশশ্মানে কবির শরীর বিলিন হল পষ্ণভূতে।