বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেই হয় দুর্গাপুজো। তবে কিছু পুজো আছে যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং রীতিনীতি অন্য পুজোর থেকে আলাদা করে। মূলত সেই সমস্ত পুজোর অদ্ভুত রীতি আজও আকৃষ্ট করে সাধারণ মানুষকে। আর সেই পুজো ঘিরে জড়িয়ে থাকা কিংবদন্তি আরও আকর্ষণীয়। এরকমই এক প্রাচীন পুজো হল মালদা শহরের কংসবনিক দুর্গাবাড়ির পুজো।
বৈদিক রীতি মেনে আজও পুজো হয়ে আসছে মালদা শহরের অন্যতম প্রাচীন দুর্গাবাড়িতে৷ চলতি বছরে এই মন্দিরের পুজো ১৪৮ বছরে পা দিচ্ছে৷ এই পুজো ঘিরে রয়েছে অনেক কথা ও কাহিনি৷ এই পুজো ঘিরে আজও মালদা জেলার মানুষজনের উৎসাহ উদ্দীপনা কমেনি। প্রতি বছর মালদা জেলার গ্রাম ও শহরের মানুষ পুজোর ৪ দিনের মধ্যে অন্তত একদিন এই পুজো দেখতে ভিড় করেন৷
ইতিহাস বলে ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মালদা শহরের নেতাজি সুভাষ রোডে আদি কংসবণিক দুর্গাবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ তবে তার অনেক আগে থেকেই এই পুজো চালু ছিল বলে উদ্যোক্তাদের দাবি৷ পুজো কমিটির বর্তমান সভাপতি উত্তমকুমার দাস জানিয়েছেন, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে এই পুজো শুরু হয়৷ সেই সময় শহরের বাবুপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন এক বৃদ্ধা৷ একদিন তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন স্বয়ং মা দুর্গার৷ মা তাঁকে জানান, এলাকার নিমতলা ঘাটে তিনি পাথর বা শিলা রূপে বিরাজ করছেন৷ তাঁকে যেন মহানন্দা নদী থেকে তুলে এনে পুজো করা হয়৷ দেবীর আদেশ পেয়ে সেই বৃদ্ধা পরদিন নিমতলা ঘাটে গিয়ে মহানন্দা নদী থেকে একটি পাথর খুঁজে পান, এবং সেটি তুলে নিয়ে আসেন নদী থেকে৷ ওই ঘাটের পাশেই নিমগাছের নীচে তিনি সেই পাথরটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ সেখানেই প্রথম শুরু হয় দেবীর পুজো৷ পরবর্তীকালে স্থানীয় জমিদার ওই পাথর নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে, এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বিনয় সরকার রোডে অবস্থিত তৎকালীন জমিদার গিরিজানন্দ দাসের বাড়িতে আজও পুজো পান মা দুর্গা৷ গিরিজানন্দই সেই পুজো শুরু করেন৷ কিন্তু একসময় জমিদার গিরিজানন্দ বুঝতে পারেন, তাঁর পক্ষে বেশিদিন মায়ের পুজো চালানো সম্ভব নয়৷ সেকারণে তিনি পাথরে প্রতিষ্ঠিত দেবীকে কংসবণিক সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেন৷ সেটা ১২৭৫ বঙ্গাব্দ৷ সেবছরই দুর্গাবাড়িতে মায়ের নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়৷ তখন থেকে এখনও অবিচ্ছিন্নভাবে দুর্গাপুজো এখানে হয়ে আসছে ৷
এই কংসবনিক দুর্গাবাড়ির দুর্গাপুজোর কতগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ মহালয়ার ভোরে ঘটপুজোর মধ্যে দিয়ে পুজো শুরু হয় এবং লক্ষ্মীপুজোতে এই পুজোর সমাপ্তি ঘটে৷ এতদিন ধরে কোথাও দুর্গাপুজোর চল রয়েছে কিনা তা জানা যায় না৷ সপ্তমীর দিন সকালে সেই নিমতলা ঘাটেই দেবীর ঘট ভরা হয়৷ পুজোতে অন্নভোগের প্রচলন নেই। আড়াই কিলো আটার ঘিয়ে ভাজা লুচি দিয়ে ভোগ তৈরি হয়৷ বাসন্তী পুজোতেও সোওয়া কিলো আটার লুচির ভোগ হয় এখানে৷ একানকার দেবীমূর্তিকে ঘিরে থাকে আরও ২২টি মূর্তি৷ আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কংসবণিক সম্প্রদায়ের ২৩৬টি পরিবার এই পুজোর আয়োজন করে থাকেন৷ এই পুজোতে কোথাও থেকে কোনও চাঁদা সংগ্রহ করা হয় না৷ পুজোর ৪ দিন অসংখ্য মানুষ মন্দিরে আসেন৷ এই পুজো না দেখলে বোধহয় সবারই পুজো দর্শন অপূর্ণ থেকে যায়।
You must be logged in to post a comment.