দু’চাকাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাই নিয়েই বেড়াতেন ঘুটিয়ারি শরিফের আমিনুর ইসলাম। পেশায় গৃহশিক্ষক। অঙ্কে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর বিএড করেছেন। কিন্তু চাকরি জোটেনি। সাইকেলে চেপে সোনারপুর থেকে ক্যানিং ছেলে পড়িয়ে বেড়ান। আমিনুরের এই সাইকেলই এখন আলো দেখাচ্ছে গোসাবার প্রত্যন্ত গ্রামের পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের। সেইসব পড়ুয়াদের না আছে স্মার্টফোন, না মেলে উন্নত ইন্টারনেট পরিষেবা। ফলে গত দেড় বছর ধরে পড়াশোনায় ইতি পড়ে গিয়েছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলির। আমিনুর এবং তাঁর মতো আরও কয়েকজনের উদ্যোগে হাসি ফুটেছে পড়ুয়া ও পরিবারের মুখে।
ভাবনাটা এসেছিল ‘যশ’ পরবর্তী সময়ে গোসাবায় ত্রাণ দিতে গিয়ে। তখনই মনে হয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত মানুষজনের খাওয়া-পরার সংস্থান না হয় হল। কিন্তু বাচ্চাদের পড়াশোনার কী হবে! বলছিলেন আমিনুর। ফিরে এসে সমমনস্ক বন্ধুবান্ধব ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেন তিনি। সকলে মিলে ঠিক করেন, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে প্রতি রবিবার সাইকেলে করে গিয়ে তাঁরা পড়াবেন ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের। শুরুতে আমিনুরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু সুতপা মণ্ডল, রাহুল দেওয়ান, আমিনুরের ছাত্র মানসিজ জিনাত, সুমন হালদার ও আমিনুরের বাবা আলি হোসেন সর্দার।
আমিনুর বললেন, মনে হল আমার নামটাই ছিল তাঁদের আপত্তির প্রধান কারণ। কিন্তু দমে না গিয়ে তাঁরা ঘুরতে থাকেন। সুকুমারী আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে প্রস্তাব দেওয়া মাত্র স্থানীয় বাসিন্দারা তা লুফে নেন। বাঁধের ধারে ভেঙে পড়া একটি ক্লাবঘরকে সারিয়ে আমিনুরদের ক্লাস নেওয়ার জায়গা করে দেন তাঁরা। শুরুতেই ক্লাসে হাজির ৩০ জন পড়ুয়া। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ৬০। কিছু দূরে দয়াপুরেও ক্লাস করান তাঁরা। সেখানকার দয়াপুর সেন্ট্রাল অবৈতনিক স্কুলের শিক্ষক দিবাকর মণ্ডল এগিয়ে আসেন আমিনুরদের সাহায্য করতে।
শুরুতে আমিনুররা ছিলেন পাঁচ-ছ’জন। এখন বাড়তে বাড়তে শিক্ষকের সংখ্যা ১৫-১৬তে গিয়ে ঠেকেছে। তার মধ্যে আছেন স্নিগ্ধা দত্তবণিক। তিনি কলকাতার আলিপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে প্রতি রবিবার গোসাবা আসেন পড়াতে। কিন্তু সাইকেলে কেন? আমিনুর বলছেন, পরিবেশ দূষণ বিরোধী বার্তা দিতেই সাইকেলে সফর। গোসাবা যাওয়ার পথে এই বার্তা দিতে দিতেই যান তাঁরা। তাই তাঁদের এই উদ্যোগের নামকরণ করা হয়েছে ‘দু’চাকার পাঠশালা— আলোর সন্ধানে’। আগামী দিনে এই উদ্যোগকে গোটা রাজ্যে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন এই পাঠশালার সদস্যরা।