জেলা

জলমগ্ন হাবড়ার কিছু অঞ্চল, চলছে রাজনৈতিক চাপানউতর, সমাধান কী

বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী নিম্নচাপের প্রভাবে হাবড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন জলমগ্ন। গত বছরও একই পরিস্থিতি হয়েছিল কিন্তু পাম্প বসিয়ে জল সেচ করে কিছুটা উন্নতি করা গেলেও এবার বর্ষার পরিমাণ বেশি হওয়ায় অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আসলে হাবড়ার যানজটের মত হাবড়ার নিকাশি সমস্যাও দীর্ঘ দিনের। আর সব রাজনৈতিক দলই যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছে, শুধু উপরি ভাবে, সাময়িক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে- এর কোন স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করেনি।

হাবড়ার নিকাশি ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধান করতে গেলে হাবড়ার ভৌগলিক অবস্থা জানতে হবে, কারণ জল কোন রাজনৈতিক রঙ বোঝে না, গায়ের জোর মানে না, সে শুধু ভূমির ঢাল বোঝে। হাবড়া আসলে একসময় পদ্মা নদীর পারে গজিয়ে ওঠা একটি গঞ্জ। যে পদ্মা নদীয়া জেলায় যমুনা নদী থেকে বেরিয়ে স্বরূপ নগরের টিপির কাছে আবার যমুনায় মিশে অবশেষে ইছামতী নদীতে গিয়ে পরেছে। ফলে পদ্মা যমুনার উপনদীও বটে আবার তার শাখা নদীও। এই কারণে হাবড়ার ভূমির ঢাল উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে।

পুরনো পদ্মা নদীর বর্তমান অবস্থা

পরবর্তী সময়ে পদ্মা নদী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। সুযোগ বুঝে এক শ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে নদীর জমি দখল করে পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তা বানিয়ে তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত ও স্থায়ী করেছে। কিন্তু বর্ষার সময় জল তার পুরনো খাতেই বইতে চায়। না পেরে দু’পাশ ভাসায়। তাই খেয়াল করলে বোঝা যায় বর্ষায় হাবড়ার যে অঞ্চলগুলি এখনও জলমগ্ন হয় সেগুলি সবই পদ্মা নদীর দু’পাশের বা নদীর মধ্যে দখল করে করা বসতি এলাকা। কারণ নদী মজে গেলেও ভূমির ঢাল কিন্তু পাল্টে যায়নি।

২০০১ সালে বিখ্যাত পরিবেশ-বিদ সুভাষ দত্ত এসেছিলেন পদ্মা নদীর সমীক্ষা করতে। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, “পরিবেশ কর্মী হিসাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক পুকুর চুরি দেখেছি, নদী আটকে ভেড়ি, ইটভাটা করতে দেখেছি কিন্তু এই পদ্মা নদী না দেখলে জানতাম না যে আস্ত একটা নদী চুরি হয়ে যেতে পারে।” ১৯৫৬ সালে যেবার হাবড়ায় বন্যা হয়েছিল সেবারও নদীয়ার নাপতের জোল হয়ে জল হাবড়ার বিলকে(যা আসলে পদ্মার পুরনো নদী খাত) ভাসিয়ে ছিল।

নদী মজে যাবার পরও হাবড়ার জলের দুটি নিকাশি পথ ছিল। পথ দুটি আসলে পদ্মারই দুটি মুখ। একটি পোস্টঅফিস রোডের ডান পাশ দিয়ে, যার উপরেই অ্যাথলেটিক ক্লাব ও মাঠ হয়েছে, যার পারেই ইংরেজ সাহেবদের কুঠি ছিল, আর অপরটি কামিনিকুমার স্কুলের কাছ দিয়ে।

প্রথম পথটির জল পুরনো বাটার দোকানের সামনে যশোহর রোডের উপর কালভার্ট(যার এখন কোন অস্তিত্ব নেই) দিয়ে  বর্তমান পিএল মেডিক্যাল গলি হয়ে তেঁতুলতলা বাজার হয়ে জয়গাছি রেল গেটের কাছে রেল লাইনের তলার কালভার্ট হয়ে গোয়ালবাটির কাছে নাংলার বিলে পরত। হাবড়া বাজার, তেঁতুল-তলা বাজার হওয়ায় এই পথের আর কোন অস্তিত্বই নেই। কিন্তু কিছু বছর আগে পর্যন্ত অপর পথটি ছিল হাবড়ার জল নিকাশির একমাত্র পথ। সেটি কামিনিকুমার স্কুলের পাশ দিয়ে জিরাট রোডের কালভার্টের তল দিয়ে বিএসএনএল অফিসের তল দিয়ে ESSO পাম্পের কাছে যশোহর রোডের তলার কালভার্ট হয়ে দক্ষিণ হাবড়ার মৃতপ্রায় পদ্মা নালা হয়ে আক্রমপুর, খড়ের মাঠ হয়ে নাংলার বিল দিয়ে চাতরার কাছে পদ্মা দিয়ে বয়ে যেত।

বর্তমান পদ্মা নালা

পরবর্তী সময় বাম আমলে অশোকনগরের এক সিপিএম নেতা পদ্মার মধ্যে ৫২টি পরিবারকে রাতারাতি বসিয়ে দেয়, যা আজ ৫২ পল্লী নামে পরিচিত। এরপর কামিনিকুমার স্কুল মাটি ফেলে স্কুলের খেলার মাঠ বানায় ও বাকি পথটুকুও আটকে যায়। তবুও যেটুকু ছিল তা যশোহর রোড পার করে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়। কারণ রাজনৈতিক পালা বদলের পর সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে অট্টালিকা তৈরি হয়। আর হিজলপুকুরে পদ্মা নালার উপর হনুমান মন্দির তৈরি করায় হাবড়ার জল যাওয়ার শেষ পথটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ফলত দেখা যাচ্ছে জলের এই পুরনো পথটিকে কোন ভাবে উদ্ধার করতে না পারলে হাবড়া শহরের নিকাশি সমস্যার কোন দিনই সমাধান হবে না। বছর বছর দেওয়া রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি  যে কেবল কুমিরের চোখের জল তা হাবড়ার মানুষ অচিরেই বুঝতে পারবে। আর আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য যেভাবে বর্ষা বাড়ছে তাতে বছরে ছয় মাস এভাবেই জলমগ্ন হয়ে থাকতে হবে। সাময়িক ভাবে দশটা পাম্প লাগিয়ে এর সমাধান হবে না।