তিন বছর আগে দু’দেশের মধ্যে ডোকলাম স্ট্যান্ডঅফের মূল কারণ ছিল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত চিনের ১২ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা তৈরি। মেরুগ লা থেকে ডোকলাম সংযোগকারী ওই সড়ক সীমান্তের কাছে সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল চিনের সেনাকে। ভারত রুখে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হল, তখন দেশের সেনাবাহিনী একেবারেই শক্তিশালী ছিল না। কারণ ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল কাটিয়ে তখনও সার্বিকভাবে দেশ গঠনের কাজ আরম্ভ হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর নির্দিষ্ট নীতি তৈরি হয়।
এদিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে, দুর্গম এলাকার ভারতীয় পোস্ট দৌলত বেগ ওল্ডি (ডিবিও) পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা আগেই বানিয়ে ফেলেছিল ভারত। ২০১৯ সালের সেই সড়কের উপর একটি সেতুর উদ্বোধন করে আসেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। সেই রাস্তারই শাখাপ্রশাখা তৈরি করতে শুরু করেছিল বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন। উল্লেখ্য, ভারত স্বাধীনতার পর নিজেদের সীমান্ত বিষয়ক নানা সমস্যায় নজর দেওয়ার আগে সংবিধান রচনা থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়গুলি গুছিয়ে নিতে চেয়েছিল। তখন ১৯৫০ সালে তিব্বত দখল করে চিন।
অন্যদিকে অতীতের কথা মাথায় রেখে ভারত লেহ থেকে দরবুক, তার পর শিয়ক নদী ধরে ডিবিও পর্যন্ত সব রাস্তা পরিকল্পনামাফিক তৈরি করে। এই রাস্তা তৈরি হয়ে গেলে গলওয়ান উপত্যকায় ভারত অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে যাবে, যা কিছুতেই মানতে পারেনি বেজিং। যাকে কেন্দ্র করে চিনের সেনার আগ্রাসী মনোভাবে কয়েক সপ্তাহ ধরেই উত্তপ্ত পূর্ব লাদাখ। তবে ডোকলামে যেমন চোয়াল শক্ত করে ৭৩ দিন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় সেনা, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
তখন থেকেই লাদাখের উপর নজর ছিল চিনের। তবে পুরোটা দখল করতে না পারলেও আকসাই চিন এলাকাটি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। কারণ ওই এলাকায় তখন ভারতীয় সেনার প্রহরা ছিল না। যে সুযোগ নিয়ে চিন এলাকাটি দখল করে নেয়। আর বলতে থাকে এলাকাটি তাদের। হিমালয় পর্বত আর তিব্বতীয় মালভূমির উপস্থিতির জন্য সীমান্তে নিজেদের এগিয়ে রাখতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে দুই দেশকেই। বিগত কয়েক দশক ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর নিজেদের পরিকাঠামোর উন্নতি করে চলেছে চিন। ২০১৭ সালের জুন মাসে এমনই এক রাস্তা নিয়ে দু’দেশের উত্তেজনা চরমে পৌঁছয়। মেরুগ লা থেকে ডোকলাম থেকে যে সড়ক চিন সেনা বানাচ্ছিল। সারা বছরই ডোকলামে সেনার যাতায়াত নিশ্চিত করতে চেয়েছিল বেজিং। ইয়াতুং থেকে জেলেপ লা পর্যন্ত একই ধরনের রাস্তা বানানোর চিনের পরিকল্পনাও তখন সামনে আসে। ডোকলামকে কেন্দ্র করে গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত, হেলিপ্যাড, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব, এমন পরিকাঠামোও তৈরি করে চিন।
এই পরিস্থিতিতে লাদাখে চিনের সেনার দাপাদাপি দেখে ভারত ওই এলাকায় সেনা মোতায়েন করে। যাতে চিনের আগ্রাসনকে দমিয়ে রাখা যায়। ১৯৬১ সালে ভারত ফরওয়ার্ড পলিসি নেয়। সীমান্ত ধরে এগোনোর চেষ্টা করে। তবে তখন সেই অভিযান সফল হয়নি। ১৯৬২ সালে ফের একবার চিনের আগ্রাসনকে থামানোর চেষ্টা হয়। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন গলওয়ান উপত্যকার গুরুত্ব বুঝে ওই এলাকাতে ভারতের শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ৫ জুলাই গলওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনার পোস্ট বসানো হয়। ফলে ওই এলাকায় চিনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়।
১৩ হাজার থেকে ১৬ হাজারের উচ্চতার এলাকা দিয়ে যাওয়া গোটা পথে বেশ কয়েকটি খরস্রোতা নদী পড়ে। গলওয়ান নদীর উপর এমনই একটি সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর চিনের আরও বেশি চক্ষুশূল হয়ে ওঠে ভারত। এখনও পর্যন্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে সার্বিক পরিকল্পনার ৭৫% রাস্তাই তৈরি করে ফেলেছে বিআরও। আগামী বছরের মধ্যে লাদাখ, উত্তরাখণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ মিলিয়ে আরও ২০টি রাস্তা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। উল্লেখ্য, গলওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনার পোস্ট এমন জায়গায় ছিল যেখানে চিনের সেনা এগিয়ে এলেই ভারত তাদের আটকাতে সক্ষম হবে। ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে ভারত চিনকে প্রস্তাব দেয় লাদাখের এলাকা থেকে সরে যেতে। আকসাই চিন এলাকার রাস্তা অসামরিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে বলে ভারত রাজি হয়েছিল। তখন সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি চিন। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে লাদাখে ভারতীয় সেনাকে আক্রমণ করে এবং দুই দেশের যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৬২ সালের যুদ্ধ ভারতকে কিছুটা অবাক করে দিয়েছিল। চিন লাদাখের অনেকটা এলাকা দখল করে নেয়। এবং এই মুহূর্তে ফের একবার চিন নিজেদের অবস্থান বদল করে ফেলেছে। সবই করা হচ্ছে, সহজে সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার জন্য। যা মোটেই ভালভাবে নিচ্ছে না চিন। গলওয়ানের হাতাহাতি তারই নমুনা হয়ে থাকল।