Government distributes food through rationing system and corruption occured.
মতামত

রেশন দুর্নীতি

করোনা সংক্রমণ,লকডাউন,কর্মহীন হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষ,খাদ্যের অভাব,সরকারি উদ্যোগে খাদ্যদ্রব্য বিলি,রেশন ব্যবস্থা ও দুর্নীতি।এই সমস্তটা আসলে একটা সিস্টেম। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তবে রেশন দুর্নীতি সর্বকালের সব সরকারের আমলেই সরকারি দুর্নীতির পীঠস্থান। সাধারণ  দৈনন্দিন জীবনে এই বিষয় নিয়ে মানুষ জানলেও কর্ম ব্যস্ততায় ভাবার অবকাশ খুব একটা পায় না। কিন্তু সংকটকালে যখন এটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে তখন আলোচনার কেন্দ্রে আসতে বাধ্য, তা মিডিয়ার আলোর নীচে আসুক বা না আসুক।

ত্রাণের রিলিফ বণ্টনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রসার আরও বেশী হয়। দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের সময় থেকে এই বঙ্গের শহরগুলিতে পুরদমে রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।কম দামে চাল,আটা বা গম,চিনি,কেরোসিন শস্তা দামে রেশন দোকান থেকে রেশনকার্ড আনুসারে বিক্রি হত। অনেক রেশন দোকানের মালিক মিথ্যা নামে জাল রেশন কার্ড বানিয়ে ওই কার্ডের নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বেশী দামে কালো বাজারে বিক্রি করতেন। এই দুর্নীতি ধরার জন্য খাদ্য দপ্তর অফিসার নিয়োগ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্নীতি বন্ধ করা যেত না বা করা হত না। কিন্তু বন্যা, খরা বা অন্য সংকটকালে ত্রাণ সামগ্রী বিলির ক্ষেত্রে ওই ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো থাকে না। ফলে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য অল্প সংখ্যক কর্মীর পক্ষে নজর রাখা সম্ভব নয় বা  সেই চেষ্টাও করা হয় না। যেমন এখন প্রচুর মানুষ করোনার জন্য রেশনে বেশী করে যে খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হচ্ছে তা ওই রেশন দোকানেই বা তার আশেপাশে দোকানে বেশী দামে বিক্রি করে তা দিয়ে আরও ভাল চাল কিনে নিচ্ছে। আর ওই চাল বিভিন্ন হাত ঘুরে সরকারের কাছেই যাচ্ছে। ফলে একই চালে প্রচুর টাকা ভর্তুকি দিয়ে সরকার বারবার কিনছে।

১৯৬৬-৬৭ সালে বিহারে খরার জন্য কোন ফসল ফলে না। এই অবস্থায় রিলিফের জন্য নানা ধরনের সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়ানোর দরকার হয়। এই বিরাট কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে এবং তা সরকারের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হবে না। তাই সেই সময়ের বিহারের কংগ্রেস সরকার অনেক ভেবেচিন্তে কংগ্রেস বিরোধী জননেতা জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে একটি সর্ব দলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করেন। সংবাদ পত্রে খবর বের হতে শুরু করে যে বিহারে রিলিফের জিনিসপত্র অনেক বেশী দামে কালো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ফাদার জেরাল্ড বেকার্স কয়েকজন ছাত্রকে বিহারে খরা ত্রাণের কাজে পাঠান। তাদের একজনকে জয়প্রকাশ নারায়ন দায়িত্ব দেন যে কি পরিমাণে রিলিফের জিনিস কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে সেই বিষয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিতে। রিপোর্টে দেখা যায় প্রায় ৯০ শতাংশ ত্রাণ সামগ্রী কালো বাজারে চলে যাচ্ছে। পরে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন ও কালোবাজারি বন্ধ করেন।

১৯৬৮ সালে উত্তরবঙ্গে বন্যা হয়। তখন পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের শাসন চলছে। সরকারি ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়। কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ ভেবেছিলেন, ত্রাণ সামগ্রী বিলি করেই কংগ্রেস নির্বাচনে জিতবেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে শুধু ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির কারণে কংগ্রেস উত্তরবঙ্গে তার আগের আসনগুলিও হারায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এক কোটির উপর উদ্বাস্তু ভারতে চলে আসে। স্বভাবতই ভারত সরকারকে তাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিতে হয়। প্রশাসনের মাধ্যমে রেশন বণ্টন চালু হয়। যশোহরের আওয়ামী লীগের এম পি মোশারেফ হোসেন এবং গোপালগঞ্জের এম পি শ্রী গৌর বালা বনগাঁয় থেকে রেশন বণ্টনে সাহায্য করেন।  তা সত্ত্বেও যুদ্ধের পরে বনগাঁর এসডিও রেশন বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অতএব এই ধরনের রেশন বণ্টনে দুর্নীতি আটকানো কঠিন।

এই লকডাউনের সময় রেশন বণ্টনের ভার প্রশাসনের উপর। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সমাজসেবী সংগঠনকে সঙ্গে না নিয়ে শুধু খাদ্য দপ্তরের সচিবকে বদলি করে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কি দুর্নীতি-মুক্ত ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারবেন?

লেখকঃ নিরঞ্জন হালদার
প্রাক্তন সহ সম্পাদক, আনন্দ বাজার পত্রিকা।