অর্থনীতি মতামত

মহামারির পর অগ্রাধিকার পাবে কে- মানুষ নাকি অর্থ?

সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এই নতুন ভাইরাস মানুষের ওপর থাবা বসানোর ব্যাপারে কোনো বৈষম্য করছে না, কিন্তু তার বিধ্বংসী প্রকোপ যেভাবে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা অবশ্যই বৈষম্যমূলক। একটা বিষয় হতাশার হলেও পরিষ্কার যে এই মহামারি গরীব মানুষকে আরো গরীব করছে।

লকডাউনের সময় যেমন অনেকে ঝলমলে বাগানে রোদ পোহাচ্ছে, প্রকৃতিকে উপভোগ করছে, কিন্তু অনেকের জন্য তাদের ঘুপচি ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট বারান্দাটাই বাইরের খোলা আকাশের সাথে যোগাযোগের একমাত্র পথ। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই মহামারির দাপটে যারা চাকরি হারাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ এবং নারী, যারা এমনিতেই কম বেতনের চাকরি করতেন। আনুপাতিক হিসেবে ভাইরাসের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। যারা দিন এনে দিন খেতেন, লকডাউনের কারণে সেই দিনমজুরদের এখন খাবার জুটছে না।

তারপরেও এই সঙ্কট কি কোথাও পরিবর্তন আনবে?

এই ধরনের বড় সঙ্কট এই প্রথমবার আসেনি। যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ২০০৮ সালে বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল, তারপর ব্রাজিলে সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এশিয়ায় যে মন্দা দেখা দিয়েছিল, তারপর থাইল্যান্ড চালু করেছিল সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা। আরও পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। আমেরিকায় মহামন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) ফলে জন্ম নিয়েছিল সামাজিক নিরাপত্তাসেবা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। একটা সঙ্কট সমাজকে নতুন করে ভাবতে শেখায় কী করণীয়, যা অন্য সময়ে মানুষের ভাবার অবকাশ হয় না। এই সঙ্কট কি আমাদের আত্মত্যাগ করতে শেখাবে – যার ফলে পৃথিবীতে আরও সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে?

বিপুল আর্থিক ক্ষতি

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আমেরিকার সিয়াটেলে ছোট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে এমনটাই ঘটেছে। গ্র্যাভিটি পেমেন্টস নামের এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসার পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৫ সালে যুগান্তকারী একটা সিদ্ধান্ত নেয়। কম্পানির কর্ণধার ড্যান প্রাইস নিজের আয় দশ লাখ ডলার কমানোর সিদ্ধান্ত নেন, যাতে সেই অর্থের ভাগ তার কর্মচারীরা পায়। তার এই সিদ্ধান্তের পরে সংস্থায় কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ে, সংস্থার ব্যবসা বাড়ে, মুনাফা বাড়ে, কর্মচারীরা আয় বেড়ে যাওয়ায় বেশি কাজ করতে থাকেন, কর্মচারীরা বাসা-বাড়ি কিনতে শুরু করেন – একটা খুশির আবহাওয়া তৈরি হয় সংস্থায়।

কিন্তু তারপর এই মহামারি এসে সব তছনছ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে বিবিসির সঙ্গে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রাইস বলেন, তিনি হতাশ। তার চোখেমুখে ছিল দিশেহারা মানুষের ছাপ। তিনি বলেন, আমার কোনোদিন মাথা ধরতো না। গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে আমার মাথা ধরা যাচ্ছে না।

ক্রেডিট কার্ডে যেসব ক্রেতা নানা ধরনের পাওনা মেটান, বিভিন্ন সংস্থার হয়ে সেই লেনদেনের প্রক্রিয়া দেখভাল করে তার কম্পানি। সবরকম ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে পড়ায় তার ব্যবসা অর্ধেক কমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে তাকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে। প্রাইস চান না তার কর্মচারীদের জবাব দিতে। বিশেষ করে এই সময়ে যখন তাদের বেতনের প্রয়োজন, প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবার।

অন্যদিকে যারা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে পাওনা মেটাচ্ছেন, তাদেরও হাতে নগদ অর্থের অভাব, তাদেরও অর্থনৈতিকভাবে শাস্তি দেয়া অমানবিক। এখানেই দেখা যাচ্ছে একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

প্রবৃদ্ধির আগে মানুষ

এই মহামারির প্রকোপে সারা বিশ্ব এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সামাজিক পরীক্ষার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, যে পরীক্ষার মুখোমুখি মানবজাতিকে আগে হয়ত এভাবে হতে হয়নি। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। একের পর এক দেশগুলো আটকে যাচ্ছে নজিরবিহীন লকডাউনে। তাসের ঘরের মত ধসে পড়ছে অর্থনীতি, সমাজ জীবন। দেশগুলো তাদের অর্থনীতি অচল করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারকে প্রবৃদ্ধির আগে ভাবতে হচ্ছে মানুষের কথা, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা।

বিশ্ব ব্যাংকে ইতালিয় ঊর্ধ্বতন অর্থনীতিবিদ ইউগো জেন্টিলিনি বলছেন, তিনি খুবই আশাবাদী। মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত গরীব মানুষদের সহায়তায় প্রতিদিনই নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আমরা সবাই চাইব এই লকডাউন সাময়িক হবে। কিন্তু এরই মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেকেই সমাজ রক্ষার কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

তার গবেষণায় তিনি বলছেন, নগদ অর্থ সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেবার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলে ৬২ কোটির ওপর মানুষ এই মহামারির সঙ্কট কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। কোন কোন দেশের সরকার চেষ্টা করছে যাদের আসলেই এই অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন – তাদের কাছে পৌঁছতে, তিনি বলছেন।

মরক্কো আর কলম্বিয়াতে ইউটিউব ভিডিওতে মানুষকে অর্থসাহায্যের জন্য আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। উগান্ডাতে উঠতি বয়সের মেয়েদের সাহায্যের জন্য অনুদান দেয়া হচ্ছে। ভারত সরকার বলছে, সরকারি কর্মসংস্থান প্রকল্পে নথিভুক্ত দুই কোটি ৭৫ লাখ মানুষ যতদিন কাজ করতে না পারছে ততদিন তাদের নগদ অর্থ দেয়া হবে।

কলম্বিয়ার রাজধানী বোগটাতে ৫ লক্ষ পরিবারকে নগদ অর্থ দেয়া হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার এবং পারিবারিক সহিংসতা না চালানোর প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। গত কয়েক সপ্তাহে যে কয়েকশ’ প্রকল্পের ঘোষণা এসেছে এগুলো তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি। জেন্টিলিনি বলছেন, এসব প্রকল্প কতদূর কাজ করবে তা এখনই বলা কঠিন, তবে তিনি আশাবাদী এসব প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সেগুলো হয়ত স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে।

আমূল পরিবর্তনের ভাবনা

সামাজিক এবং পরিবেশ বিষয়ে সক্রিয় বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল জাস্টিস নাউ-এর ডরোথি গুয়েরো বলছেন, এই লকডাউন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন যে বিপন্ন করে তুলেছে তাতে তিনি অবশ্যই উদ্বিগ্ন। কিন্তু তিনি মনে করেন বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি বলে যেটাকে ধরে নেয়া হয় এই মহামারির পর সেটাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সময় এসেছে। তিনি বলেন, বড় বড় দেশগুলোর সরকারের ভূমিকা এখন সবকিছুর সামনে চলে এসেছে। তারা কী করবে সেটাই এখন অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াবে। আগে সবসময় বলা হয়েছে সবকিছুই আন্তর্জাতিক বাজার-নির্ভর। বাজার দিক নিদের্শনা দেবে, বাজার ভুল সংশোধন করবে, বাজার সমস্যা সমাধান করবে। এখন যেসব পদক্ষেপ বেশিরভাগ দেশের সরকার নিচ্ছে, সেগুলো তারা নিচ্ছে নিজ উদ্যোগে। আন্তর্জাতিক বাজার সেসব ঠিক করে দিচ্ছে না।

গুয়েরো বলছেন, সম্প্রতি পোপ বলেছেন, বিশ্ব জুড়ে একটা মৌলিক বেতন কাঠামো ঠিক করার সময় হয়ত এখন এসেছে, যার মাধ্যমে মানুষের একই ধরনের কাজের সমান স্বীকৃতি দেয়া যাবে। তিনি বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে একটা সার্বিক মৌলিক বেতন কাঠামো একেবারেই আমূল পরিবর্তনের একটা ভাবনা। কায়িক শ্রমের, বা স্বল্প-দক্ষতার অনেক কাজ; যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন, এসব পণ্য গুদামজাত করা, দোকানের তাকে তা পৌঁছে দেয়া, ফসল তোলা এগুলো আমাদের জীবনধারণের জন্য কত প্রয়োজন তা আমরা এখন দেখছি এবং তাদের কাজের মূল্য বুঝছি।

এই ধরনের কর্মীরা যদি তাদের কাজের জন্য বেশি বেতন দাবি করে, তিনি বলছেন সেটা দয়া দাক্ষিণ্য হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আমি ফিলিপাইনের। আমি জানি বহু ফিলিপিনো নার্স এই ভাইরাসে মারা গেছেন। হয়ত এরপর নার্সরা আরও বেতন, আরও সুরক্ষার দাবি জানাবেন।

গবেষণায় দেখা গেছে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির পরেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। বেতন ও কাজের পরিবেশ নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা ওই মহামারির পর কর্মদাতার দিক থেকে কর্মচারিদের হাতে চলে যায়। কিন্তু এই দুঃসময়ে সাম্য আনতে অর্থ লগ্নি করবে কে?

শিকাগোর গ্র্যাভিটি পেমেন্টসের কথাই ধরা যাক। সেখানে মালিক বা কম্পানির কর্ণধার কাউকে ছাঁটাই করতে চান না, যদিও কোন ব্যবসা লাটে উঠলে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে পৃথিবীর সর্বত্রই কর্মীদের ছাঁটাই করাই দস্তুর। সংস্থার প্রধান প্রাইস এই ঘাটতির বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরেই চাপাতে চান না। তাহলে?

আমেরিকার কোটিপতিদের কাছে তিনি দেন দরবার করছেন। সরকার শুধু বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে প্রণোদনা দিতে আগ্রহী। ছোট ব্যবসাগুলো বাঁচাতে সরকারের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি বলছেন। এই মহামারির কারণে যে মন্দা তৈরি হয়েছে তা সামাল দিতে বড় বড় দেশের সরকারগুলো আগামী কয়েক মাসে কী পদক্ষেপ নেয় তা গুরুত্বপূর্ণ।

এই মন্দার ভার কে বহন করবে – ধনীরা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী না কি নাভিশ্বাস ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণি-সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে যারা, তারা বলছে সেই সিদ্ধান্তই এখন সরকারগুলোর সামনে। একজন অর্থনীতিবিদ জেসন হিকেল বলেছেন, সবটাই নির্ভর করবে সরকারগুলো কিভাবে এই মহামারির মোকাবেলা করে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হয় তার ওপরে। এমন একটা অর্থনীতির প্রয়োজন যা কাজ করবে মানব কল্যাণে এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে।

তিনি বলছেন, এই ভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে ভাইরাস-আক্রান্ত বেশ কিছু শহরের মেয়র বলেছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আগে মানুষের কথা ভাবতে হবে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি শহরের মেয়রদের একটি গোষ্ঠি বলছে, এই মন্দার উত্তর কৃচ্ছৃতা নয়। সমৃদ্ধির মাপকাঠি যাচাই করার বদলে যাচাই করা দরকার আমার শহরের মানুষ কেমন আছে।

মূলধারার রাজনীতিকদের মুখ থেকে এমন প্রস্তাব, এমন কথা আমি আগে শুনিনি। বিশ্বের জন্য এটা একটা মাহেন্দ্রক্ষণ, বলছেন জেসন হিকেল।

বিবিসি