ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে কতগুলি শব্দ সর্বস্তরের মানুষের কাছে চেনা হয়ে গেছে। মিডিয়া ও প্রশাসনের কাছেও শব্দগুলি পরিচিত। লক ডাউন, রেড জোন, হোম কোয়ারেন্টাইন… এই তালিকায় শেষ যে শব্দটি মাত্রা যোগ করেছে সেটি ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। সাধারণ মানুষের করোনা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রেও এখন এই শব্দটি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও রাজনীতির মূল লক্ষ্য এখন এই পরিযায়ী শ্রমিকরা। যদিও কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের চিন্তার মূল কারণ তাঁদের উপকার করা নয় বরং তাঁদের নিয়ে ভোটের রাজনীতির ময়দানে ফায়দা তোলা। করোনার প্রথম দিন থেকেই সেটা পরিষ্কার।
লক ডাউনের শুরুতে এই লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা একেবারেই ভাবা হয়নি। কারণ তখন সরকারি কর্মকর্তারা অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন বিদেশ থেকে বিমানে করে সমাজের উচ্চবিত্তদের বা কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাঁদের যে ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে গেছে তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। কিন্তু শ্রমিকরা যখন শিশু কোলে অর্ধাহারে শ শ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরা শুরু করলেন তখন সরকার একটু নড়েচড়ে বসল ঠিকই কিন্তু ঘুম ভাঙল না। তার মধ্যে প্রাণ গেল অনেকেরই। মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হতেই তাঁদের উদ্ধারের চেয়ে চিঠি চালাচালিতে অনেক বেশি ব্যস্ত হলেন উভয় সরকারই, কার দোষ বেশি, দায় বেশি তা প্রমাণের লড়াই। এ দিকে যত দিন যাচ্ছে শ্রমিকদের আবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তাঁদের যার যার নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু আপাতভাবে দেখলে এই শ্রমিকরা বেঁচে গেলেন মনে হলেও বিপদ কিন্তু বাড়ল, তা যেমন তাঁদের ক্ষেত্রে তেমন সমাজের ক্ষেত্রেও।
প্রথমত, তোমারটা তুমি নাও আমারটা আমাকে ফিরিয়ে দাও, এই ঠেলাঠেলি না করে যে রাজ্যে যে শ্রমিকরা কাজে আছেন তাঁদের দায়িত্ব সেই রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে এটা বলে দিলেই মিটে যেত। কিন্তু তা না করে দেশ-ব্যপি সামাজিক দূরত্বকে ছুঁড়ে ফেলে তাঁদের ফেরানোর জন্য লোক দেখানো কর্মযজ্ঞ শুরু হল। সারা পশ্চিমবঙ্গে কম করে দশ লক্ষ শ্রমিক ফিরে আসছেন। এঁরা কিন্তু মহারাষ্ট্র বা অন্য অনেক রাজ্য, যেখানে করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি সেখান থেকে আসছেন। তা হলে যখন আসছেনই তখন প্রথম দিকে ফিরিয়ে আনলে এঁদের সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক কম থাকত। কিন্তু তা করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, এঁরা কোন পথে কী ভাবে আসছেন, তাঁদের ঠিক মত টেস্ট করা হচ্ছে কি না তা প্রশাসনের কাছে জানা থাকলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু জানেন না। যেমন আজ এই ১১-মে সোমবার রাতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাবড়ায় প্রায় ২০০ জন শ্রমিক মহারাষ্ট্র থেকে ফিরছেন। এঁরা সকলেই নাসিকে আঙুরের খেতে কাজ করেন। ওখান থেকে দুটি গাড়ি ভাড়া করে নিজেরাই রওনা দিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে এঁদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরবে না তো?
সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে? এদের রাজ্যে ঢোকার পর দুই বার থার্মাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে, যা শুধু মাত্র রোগীর জ্বর আছে কি না জানতে সাহায্য করে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দশ বারো দিনের আগে কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না, ফলে এই টেস্টের প্রকৃত অর্থে কোন মূল্য নেই। সরকারি নির্দেশে এঁদের হোম কোয়ারেন্টাইনের কথা বলা হয়েছে, যা প্রায় অসম্ভব। কারণ এঁদের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থান তাতে বেশির ভাগেরই বাড়িতে একটি বা দুটি ঘর। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা এলাকায় কাজের প্রয়োজনে এখানে ওখানে যান। অথচ বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের থাকার জন্য সরকারি তরফে কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। সাধারণত কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশেপাশের স্কুল কলেজগুলিতে ত্রাণ শিবির খুলে দুর্গতদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজনে স্কুল কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এই ক্ষেত্রে স্কুল কলেজগুলিতে কেন আলাদা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলা হল না? বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাড়িগুলিকে ব্যবহার করা হল না কেন? এলাকার মানুষ বা ক্লাবের মতো সংগঠন যে আলাদা করে কোনও ব্যবস্থা করবে তারও উপায় নেই। কারণ সেখানে দুর্ঘটনা ঘটলে তার সমস্ত রকম দায় নিতে হবে এলাকার লোককে বা স্থানীয় ক্লাবকে, বা যেখানে রাখা হয়েছে সেই বাড়ির মালিককে।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন এলাকায় যেখানে এই শ্রমিকরা ফিরছেন সেখানের মানুষ এঁদের এলাকায় ঢুকতে দিতে রাজি নন। ফলে অশান্তি শুরু হচ্ছে। আর যদি এই শ্রমিকদের থেকে কারও করোনা সংক্রমণ হয় তবে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। কোথাও কোথাও ইতিমধ্যেই ক্ষোভও শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সব বুঝেও সরকারের নির্দেশ পালনের জন্য চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই। এক দিকে রেড জোন হওয়া সত্ত্বেও বাজার-ঘাট মদের দোকান খুলে সামাজিক দূরত্বের নিয়মকে আগেই ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তার উপর এই শ্রমিকদের সমাজের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে আরও বৃহত্তর সর্বনাশের সম্ভাবনা তৈরি করা হল।