কাটমানি, রেশন দুর্নীতির ওপর কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ দুর্নীতি। একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছিল তৃণমূল শিবির। এমনকী দলের অন্দরের এই সমস্যাকে বিদ্রোহ করে সামনে নিয়ে এসেছিলেন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে ছিল যে, গোপনে দলের অনেক নেতা–মন্ত্রী গেরুয়া শিবিরে যোগাযোগ করছিলেন। দলের নেত্রীর কাছে সেই খবর এসে পৌঁছেছিল। তাই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন।
আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন যে তৃণমূল–বিজেপি’র মধ্যে হাইভোল্টেজ লড়াই হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বিজেপি’র সঙ্গে সম্মুখসমরে যোগ দিতে বিশ্বস্ত ৭ নেতাকে নিয়ে কোর কমিটি গড়লেন তৃণমূল সুপ্রিমো। বিজেপি’র জোয়ারে অনেক ঘনিষ্ঠ নেতাই দল বদলেছেন। এবার আর তাই নজর সরাতে রাজি নন মমতা। কোর কমিটিতে তাই অভিষেককেও সামিল করেছেন তিনি। কিন্তু দলের অন্দরে এখনও অনেকের প্রশ্ন দিদি ভাইপোকে জায়গা করে দিচ্ছে। এটা তো পরিবারতন্ত্রেরই দৃষ্টান্ত।
এই সাতজন হলেন—অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত বক্সি, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম দেব, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী। আবার সূত্রের খবর, ২১ জনের রাজ্য কমিটি গঠন করেছে তৃণমূল। জঙ্গলমহলকে গুরুত্ব দিয়ে গড়া হয়েছে নতুন রাজ্য কমিটি। ঝাড়গ্রামে নতুন সভাপতি হলেন দুলাল মুর্মু। রাজ্য কমিটিতে জায়গা করে নিলেন ছত্রধর মাহাত, চূড়ামণি মাহাত ও সুকুমার হাঁসদা। ফলে যে ছত্রধর মাহাতকে মাওবাদী বলে জেলে চালান করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই এখন দলনেত্রীর রাজ্য কমিটিতে জায়গা করে নিলেন। ফলে এখানে একটা বড় অঙ্ক রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তাহলে গেরুয়া আধিপত্য কমাতে জঙ্গলমহলে মাওবাদী সাহায্য নিতে হচ্ছে?
এদিকে সাংগঠনিক বৈঠকে যে রদবদল করেছেন দলনেত্রী তাতে তরুণ মুখের ভিড় বেশি। জেলায় নেতৃত্বের আসনে তরুণদের উপর ভরসা রেখেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কারণ বিজেপিকে হারাতে হলে তরুণরাই এখন তাঁর ভরসা। একাধিক প্রবীণ নেতা দল ছেড়েছেন। অন্যদিকে পুরুলিয়া জেলা সভাপতির পদ থেকে সরানো হল শান্তিরাম মাহাতকে। নতুন জেলা সভাপতি হলেন গুরুপদ টুডু। এছাড়াও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও লক্ষ্মীরতন শুক্লাকেও আনা হয়েছে তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবর নেত্রীর নেকনজরে থাকা মন্ত্রী। তিনি দলের ভেতরে থাকা রাঘববোয়ালদের কেন ধরা হচ্ছে না তা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তাই মন রাখতে তাঁকে রাজ্য কমিটিতে নিয়ে আসা হল বলে মনে করা হচ্ছে।
সাংগঠনিক বৈঠকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। জেলা পর্যবেক্ষকের পদটি একেবারেই বাতিল করে দিয়েছেন। সেই জায়গায় তৈরি করা হয়েছে জেলা কো–অর্ডিনেটর পদ। গ্রামীণ সংগঠনের কথা ভেবেই রাজ্য কমিটির নতুন সদস্য করা হল অমিত মিত্র, সৌগত রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার হাঁসদার মতো নেতাকে। উত্তরবঙ্গ তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় লোকসভা ভোটে রীতিমতো উড়ে গিয়েছিল তৃণমূল। ফলে বিধানসভা ধরে রাখতে সেই সব জায়গায় পরিবর্তন করা হল জেলা সভাপতিদের। কোচবিহারে দলে একচ্ছত্র রাজ ছিল মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। তিনি ছিলেন সভাপতিও। কিন্তু লোকসভায় সেখানে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ গিয়েছে তৃণমূল। তাই রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে সরিয়ে সেখানে সভাপতি করা হয়েছে তরুণ পার্থপ্রতিম রায়কে।
হাওড়ায় বিজেপি ঘর গোছাচ্ছিল বহুদিন। সেখানেই এবার হাওড়া জেলা (সদর) সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল মন্ত্রী অরূপ রায়কে। তার বদলে এলেন লক্ষ্মীরতন শুক্লা। কো–অর্ডিনেটর করা হয়েছে বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নদীয়ার সাংসদ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছেন মহুয়া মৈত্র। তরুণ রক্তের এই নেত্রীর কাজ করার ক্ষমতা দলেও প্রশংসিত। এবার গোটা নদীয়া জেলার সভাপতি করা হল মহুয়াকেই। দক্ষিণ দিনাজপুরেও হল রদবদল। অর্পিতা ঘোষের জায়গায় সভাপতি হলেন গৌতম দাস। মুর্শিদাবাদে নতুন সভাপতি আবু তাহের। আলিপুরদুয়ারে মৃদুল গোস্বামী, পশ্চিম বর্ধমানে জিতেন তিওয়ারি ও পূর্ব বর্ধমানে জেলা সভাপতি করা হল স্বপন দেবনাথকে। এখন প্রশ্ন একটাই, খোলনলচে বদলে কী সরকার টিকিয়ে রাখা যাবে?
