কথিত আছে, কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন তারাপীঠ মহাশ্মশানের এক শ্বেত শিমুল গাছের নীচে বশিষ্ঠ ঋষি দেবীর শিলামূর্তি পেয়েছিলেন। দিনটি ছিল অশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশী। তবে ওই মূর্তি একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল। জনশ্রুতি, পরে মা তারার স্বপ্নাদেশ পান জয়দত্ত সওদাগর। তখন বাংলায় শাসন করছেন পাল রাজারা। জয়দত্ত সওদাগরই ফের নদীগর্ভ থেকে শিলামূর্তি উদ্ধার করেন এই অশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতেই। এবং মন্দির তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন শিলামূর্তিটি। আরও পরে বর্তমান তারাপীঠ মন্দিরটি তৈরি করেন নাটোরের রানি। সেই থেকেই এই দিনটিই তারা মায়ের আবির্ভাব তিথি হিসেবে স্বীকৃত। ফলে এই বিশেষ এই দিনে তারাপীঠে পুজো শুরু হয়েছে মঙ্গলবার সকাল থেকেই।
মা তারা বছরভর পুজো পান উত্তরমুখী হয়ে। আজ আবির্ভাব তিথিতে মা’কে বসানো হবে পশ্চিম মুখে। এই একদিনই গর্ভগৃহের বাইরে আসেন তারাপীঠের মা তারা। এর কারণও বেশ আকর্ষণীয়। বীরভূমের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া মলুটি গ্রামের রয়েছেন মা তারার বোন মৌলিক্ষা। এদিন মৌলিক্ষা মন্দিরের দিকেই মুখ করে বসানো হয় মা তারাকে। প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৭০১ সাল পর্যন্ত সারা বছরের মতো আবির্ভাব তিথিতেও তারাপীঠের বিশ্রাম মন্দিরের পূর্ব দিকে মুখ করে পুজোয় বসতেন তান্ত্রিক ও পুরোহিতরা। সে সময় মালুটির নানকার রাজা রাখর চন্দ্র মায়ের সামনে আরাধনায় বসেন৷ যা দেখে তান্ত্রিক, সাধকরা রাজাকে পুজোয় বাধা দেন৷ শুধু তাই নয়, তাঁর পুজোও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অভিমানে রাজা চলে গিয়েছিলেন দ্বারকা নদীর পশ্চিম পাড়ে। এবং সেখানেই ঘট প্রতিষ্টা করে পুজো করেছিলেন। পুজো শেষে তিনি মনের দুঃখে মালুটি গ্রামে ফিরে যান। সেই রাতেই তৎকালীন তারাপীঠের প্রধান পুরোহিতকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন মা তারা। বলেছিলেন, রাখর চন্দ্র আমার ভক্ত, সে অভিমান করে চলে গিয়েছে ৷ এ বার থেকে আমার পুজো যেন পশ্চিম মুখে মলুটির কালিবাড়ির দিকে মুখ করেই করা হয়। এরপর থেকে এই নিয়মের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
এদিন সূর্যোদয়ের আগে, ঘুম ভাঙিয়ে ভোর তিনটে নাগাদ মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে মায়ের শিলামূর্তি বের করে আনা হয়। বিরাম মঞ্চে মুলুটির মা মৌলিক্ষার মন্দিরে অভিমুখে পশ্চিমদিকে বসানো হয়। এরপর জীবিত কুণ্ডু থেকে জল এনে মাকে স্নান করানোর পর পরানো হয় রাজবেশ। আবির্ভাব তিথিতে মায়ের উপোস, তাই এদিন সারাদিন কোনও ভোগ হয় না মা তারার। এই দিন অন্নের পরিবর্তে দেওয়া হয় ফল-মূল, লুচি ও সুজির ভোগ। সন্ধ্যায় মূল মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে ভোগ নিবেদন করা হয়। এদিন সকালে মঙ্গলারতির পর লুচি, সুজি ও মিষ্টি-সহ হয় মায়ের শীতল ভোগ। সারাদিন বিরাম মঞ্চে থাকার পর বিকেলে আরতির পর তারা মা-কে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মূলমন্দিরে। সেখানে স্নানের পর নবরুপে সাজানো হয় দেবীমূর্তিকে। রাতে খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচরকম ভাজা, মাছ-মাংস দিয়ে করা হয় ভোগ নিবেদন।