শিশুরা আগেও ডিভাইস ব্যবহার করতো। কিন্তু তাতে একটা রুটিন ছিল। স্কুলে গিয়েছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে বাইরে গিয়েছে, নাচের স্কুল-গানের স্কুল, মার্শাল আর্ট, ছবি আঁকা, বন্ধুদের জন্মদিন—কত কী ছিল। এখন ক্লাসও অনলাইনে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনিটরে তাকিয়ে থাকো। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতেও মেসেঞ্জার কিংবা জুম চালু করো। বিনোদন মানে মোবাইলে গেমস। এই স্ক্রিন নির্ভরতার কারণে ভয়ানক পরিবর্তন এসেছে শিশুদের জীবনযাত্রায়। শারীরিক ও মানসিক দুটো স্বাস্থ্যই হুমকির মুখে। এরই মধ্যে নেতিবাচক সাড়া দিতে শুরু করেছে চোখ। শিশুরোগী বাড়ছে আই হসপিটালগুলোতে। চিকিৎসকদের মন্তব্য ‘ভিশন সিনড্রোম’ নিয়ে আসা শিশুদেরকেই বেশি পাচ্ছেন তারা। চোখের জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ পিটপিট করা, চোখ দিয়ে জল পড়া—এই অভিযোগই বেশি শিশুদের। এসব নিয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই বলছেন চিকিৎসকরা। অভিভাবকদেরও তারা বলে দিচ্ছেন শিশুর চোখ থেকে কতটুকু দূরত্বে রাখতে হবে মোবাইল ফোন। অভিভাবকরা বলছেন, শিশুদের সেসব নিয়ম মানানো যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে এক বছরের নিচের শিশুদের ‘নো স্ক্রিন টাইম’ তথা কিছুতেই ডিজিটাল পর্দার দিকে তাকানো চলবে না। দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের জন্য বরাদ্দ বড়জোর দিনে এক ঘণ্টা। এরপর সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা ব্যবহার করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনোভাবেই শিশু যেন একনাগাড়ে কম্পিউটারের সামনে বা কোনও ডিভাইসের সামনে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে উঠে চোখের রেস্ট নিতে হবে। ২০ মিনিট পরপর অন্তত ২০-৩০ সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ রাখতে হবে। তাতে করে চোখের ওপর চাপ অনেকটা কমে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শিশুদের চোখের মাইনাস পাওয়ার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যাকে বলে মায়োপিয়া। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা কাছের জিনিস ভালো দেখলেও দূরের জিনিস দেখতে পায় না। এ সমস্যা বাড়লে শিশুরা দূরের বস্তু আর দেখবেই না। এতে কিন্তু দূর থেকে আসা যানবাহনও দেখবে না। অভিভাবকদের অনেকে ভাবেন, শিশুদের চোখের সমস্যা বোধহয় কম হয়। যার কারণে তারা পরীক্ষাও করান না। এসব শিশুর জন্য তখন সমস্যাটা আরও প্রকট হয়।
করোনার এই সময়ে বয়সের হিসেবে চোখের সমস্যা নিয়ে ভোগা শিশুদের চিকিৎসকরা দুই ভাগে ভাগ করেছেন। চার থেকে ছয় বছরের শিশু, যাদের আগে চোখের কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলছে, চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, চোখে ব্যথা-মাথা ব্যথা হচ্ছে। আরেক দল হচ্ছে আট থেকে ১২ বছরের শিশুরা। এই বয়সের শিশুদের অনলাইনে ক্লাস করতে হচ্ছে। অনেক বড় একটা সময় ওদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে জ্বলজ্বলে পর্দার দিকে। এদের চোখে শুষ্কতা দেখা দিয়েছে। চোখব্যথা তো বেড়েছেই, আগে থেকে চশমা ব্যবহার করা শিশুদের চশমার পাওয়ারও বদলে গেছে। এর মধ্যে আরেক দল পাওয়া গেছে, যারা আগে চশমা ব্যবহার করেনি, এখন লাগছে। এই ধরনের রোগীদের এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এক ফুট দূরত্বে থাকা স্ক্রিনে কিছু দেখতে থাকলে আমাদের পাপড়ি পড়ার হার কমে যায়। সে কারণে কর্নিয়ার সামনে প্রাকৃতিকভাবে যে জলের আস্তর থাকে সেটা শুকিয়ে যায়। দেখা দেয় ড্রাই আই সিনড্রোম। আর তখনই চোখ খচখচ করে। তখন ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা করে শিশুরা।
আবার যদি এক থেকে দেড় ফুট দূরত্বের ভেতরে তাকিয়ে থাকা হয় তাহলে স্বাভাবিক চোখেও মাইনাস পাওয়ার ডেভেলপ করে। তখন শিশুরা দূরের জিনিস দেখে না, ঝাপসা দেখে। আবার ছোটরা যখন টানা কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকে তখন চোখের ভেতরের দিকে বাঁকা হয়ে যাবার সমস্যা দেখা দেয়। এটাকেই আমরা ‘ট্যারা’ বলে থাকি। আবার স্মার্টফোন, ট্যাবগুলোর পর্দায় ব্যাকগ্রাউন্ড ইলুমিনেশন অর্থাৎ যেটা দিয়ে লাইট ঠিকরে বের হয় তাতে ক্ষতিকর নীল রশ্মিও থাকে। এটা চোখের রেটিনার কার্যকরী জায়গাটা নষ্ট করে দিতে পারে।