যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্র স্বপ্নদীপের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডুর অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার পুলিশ অঙ্ক বিভাগের এক প্রাক্তনী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। কিন্তু দেশের প্রথম সারির এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ সময়ের এই অসুখ কি আদৌ সারবে? সে প্রশ্নে কিন্তু সন্দিহান অনেক প্রাক্তনী থেকে অধ্যাপকদের একাংশ।
কেন বহুদিন আগে শুরু হওয়া এই ঘৃণ্য পদ্ধতি আজও চলে আসছে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার বা ইউজিসি-র নিয়ম কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে সৌরভের গ্রেপ্তারের মধ্যে। একজন প্রাক্তনী কিভাবে মেস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হতে পারে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে শুধু র্যাগিং নয়, দিনের আলোয় মদ্যপান বা গাজা সেবন সবই চলে এই ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজ্ঞান বিভাগের তথাকথিত স্বাধীন মুক্তমনা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী(কালেক্টিভ?) প্রাক্তনীদের মদতে এবং এই মতাদর্শে বিশ্বাসী একদল অধ্যাপকের প্ররচনায় বলে অভিযোগ অনেক প্রাক্তনী থেকে অধ্যাপকদের। এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তার কথায় “এই মৃত্যুর জন্য হয়ত মদ-গাঁজা দায়ী নয় তবে যেকোন অপরাধমূলক কাজের আগে বা পরে নেশা করা হয়। নেশা অপরাধ সংগঠিত করতে সাহায্য করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের পরিবেশ কলুষিত হয়।”
এদের ক্ষমতা এমন যে ২০১৩ সালে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় এদের আন্দোলনের জেরে তদানিন্তন ভিসি শৌভিক ভট্টাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এমনকি ঠিক এক বছর পর ২০১৪ সালে এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্থা করার পর তৎকালীন ভিসি অভিজিৎ চক্রবর্তী ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য কিছু নিয়ম জারি করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ও ওই র্যাগিংয়ের স্বপক্ষে যে ছত্ররা আগের বছর আন্দোলন করেছিল তারাই আবার আন্দোলন শুরু করে এই অভিযোগে যে পুলিশ কেন ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকে ছাত্রদের হেনস্থা করল। শুরু হয়েছিল ‘হোক কলরব’। সেবারও চাপের মুখে ভিসিকে পদত্যাগ করতে হয়।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই ছাত্রদের শক্তির উৎস কোথায়? যখন তথাকথিত ভোটের ময়দানে দেখা রাজনৈতিক দলগুলোর কোন ঝাণ্ডাও এদের পিছনে নেই। এদের শক্তি এখন মূলত বিপুল সংখ্যার ইঞ্জিয়ারিং ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী। আর র্যাগিং হচ্ছে ভয় দেখিয়ে জোর করে নিজেদের দলে নেওয়ার একমাত্র পদ্ধতি। আশির দশকের শেষ দিকে বা নব্বই দশকেও যাদবপুরে তথাকথিত স্বাধীন চিন্তার ছাত্রদল র্যাগিং করত কিন্তু রাজ্যে সে সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্ররা, কখনও কখনও আশেপাশের এলাকার বহিরাগতরাও ক্যাম্পাসে ঢুকে সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করতে সাহায্য করত। কিন্তু রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদল এবং নিজেদের কিছু ভুল কাজের জন্য এসএফআই আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু মেইন হস্টেলে যে প্রাক্তনীরা থাকে এবং বছরের পর বছর র্যাগিং করে এটা ছাত্র-ছাত্রী থেকে অধ্যাপকদের সবারই জানা। ডিন অফ স্টুডেন্টস, সুপার আরও ভাল করে জানতেন, সেখানে জুনিয়রদের দিয়ে মদ এনে আসর বসে তাও জানতেন, তবে নীরব ছিল কেন প্রশাসন? শুধুমাত্র সামান্য খাওয়ার খরচ দিয়ে দিনের পর দিন এই প্রাক্তনীরা কী উদ্দ্যেশে হস্টেল আটকে বসে আছে? বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলি কি জানত না? স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর এখন ছাত্র-ছাত্রিরা আন্দোলনে নেমেছে অপরাধীর শাস্তি চেয়ে, র্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাসের দাবীতে এটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু এই আন্দোলন আগে হলে একটি প্রাণ চলে যেত না। আসলে সবাই ভাবত ওই ‘একটু-আধটু’ হয়। কিন্তু এই ‘একটু-আধটু’ এর পরিমাণ কে ঠিক করে দেয়? এখন দেখার এই উত্তাল ছাত্র আন্দোলন দুদিন পর যখন আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হবে তখন ‘পুলিশ অযথা ছাত্রদের হয়রানি করছে’ বলে উল্টোদিকে ঘুরে না যায়।