রাত ১২টা বাজার পরেই ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শুরু হল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আবদুল হামিদের পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সালাউদ্দিন ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তবে এবার সে ছবিতে বদল এসেছে। অতিমারি আবহে বিধি নিষেধের কারণে সেখানে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আবদুল হামিদ। বদলে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সামরিক সচিব। তাঁরাই শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
একইসঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে সেই কালজয়ী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’ মাতৃভাষাকে ভালবেসে যে প্রাণ পর্যন্ত দেওয়া যায় তা শিখিয়েছিল ওপার বাংলা। তখন দেশের গভর্নর মহম্মদ আলি জিন্না। ঢাকার রেসকোর্সে এক সভায় ঘোষণা করলেন উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু যে বাঙালির প্রথম শব্দ ‘মা’, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কিংবা আনন্দে উচ্ছ্বাসে যে বাঙালি মায়ের ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করে তারা কেন মানবে উর্দুকে মাতৃভাষা? ভেতরে ভেতরে শুরু হল দাবানল।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিরা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর অন্যান্য বিশিষ্টজন একে একে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যান। এ বারের ২১ ফেব্রুয়ারির ছবিটা একটু আলাদা। কারণ কোভিড ১৯। আমজনতার পা পড়বে না কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে একটা বিশাল অংশের মানুষকে ঘরে বসেই সময় কাটাতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পড়ুয়া মাতৃভাষার জন্য এই আন্দোলনকে আরও জোরাল করার ডাক দিল। পাকিস্তানের পুলিশ তাঁদের রুখতে এলে বাধল ‘লড়াই’। পুলিশের পক্ষ থেকে চলল গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে গেল একদল টাটকা প্রাণ। এরপর গোটা বাংলাদেশ পথে। দাবি একটাই, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ভাষার আন্দোলন মিশে গেল মুক্তিযুদ্ধে। ‘৭১ সালে স্বাধীনতা পেল বাংলাদেশ। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।
বরাবরের মতো এবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দল বেঁধে যাতায়ত বন্ধ। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের ভিড় এড়াতে সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একসঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে দু’জন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিতে পারছেন। তার বেশি প্রবেশে বাধা। কয়েক দিন ধরেই রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের তিন দিকের রাস্তায় আলপনা ও দেওয়াল লিখনের কাজে ব্যস্ত সময় পার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। যে কোনো আন্দোলন, পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চারুকলার নাম। যে কোনও শুভ কাজের সঙ্গী তাঁরা।
করোনার কারণে খুব কম সংখ্যক জমায়েতের অনুমতি ছিল এবারের ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে। মাস্ক, স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তবে যতই বিধি নিষেধের গেরো থাকুক না কেন, আবেগের কিন্তু কোনও খামতি ছিল না অমর একুশের এই ঐতিহাসিক রাতে। ভাষার জন্য রাজপথে প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীর আর কোনও দেশে রয়েছে বলে জানা নেই। বাংলাদেশে ভাষার আবেগ ও দরদ এতটুকু কমেনি বরং বেড়েছে। এখানে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে চলা অমর ২১ বইমেলা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
