স্বাস্থ্য

শিশুর কাউন্সেলিং

অষ্টম থেকে নবম শ্রেনিতে উঠবে বিপাশা। সামনেই পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ছে নিয়মিত। মেয়ের সঙ্গে রাত জাগছে প্রবীর আর রূপাও। তাদেরও মেয়ের পরীক্ষা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের পড়ার টেবিলের পাশে বসে থাকা, দুধ গরম করে খাওয়ানো, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক মুখস্থ হয়েছে কিনা তা দেখা- সবই করছে বাবা-মা দুজন মিলে। বিপাশা পড়াশোনায় বেশ ভালোই। বাবা-মা দুজন আশা করছে সে পরীক্ষায় প্রথম হবে। কিন্তু পরীক্ষার দুদিন আগে থেকে বিপাশার শুরু হল মাথা ঘোরা, বমি আর কান্না। ও নাকি সব পড়া ভুলে যাচ্ছে। প্রথমস্থান তো দূরে থাক, সে নাকি পাশই করতে পারবে না- কাঁদছে আর এই একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে। বকেঝকে পরীক্ষার হলে ঢুকানো হল বিপাশাকে। কিন্তু প্রথমদিন পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েই তার ধুম জ্বর। শেষমেশ আর পরীক্ষা দেওয়াই হলনা। চিকিৎসক বললেন ওর শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, পুরো ব্যাপারটাই মানসিক। ওর মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে একটা ফোবিয়া বা ভয় কাজ করছে। ওর প্রয়োজন কাউন্সিলিং ।

আমাদের চারপাশে বিপাশার মতো অনেক ছেলেমেয়ে আছে। যারা নিজেদের আবেগ, অনুভূতি সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এর জন্য তারা যে নিজেরাই দায়ি তা কিন্তু নয়। প্রত্যাশার চাপ, সফল ক্যারিয়ারের ইঁদুর দৌড়, পারিবারিক জটিলতা, শারীরিকভাবে হেনস্থা শিশুমনকে বিভ্রান্ত করে তোলে। ফলে দেখা দেয় নানা ধরণের আচরণগত সমস্যা। সন্তানের এমন সমস্যা হলে, অনেক বাবা- মা এখনো ভাবেন এটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এমন ধারণা একদমই ভুল। এই সময়ে শিশুর দরকার কাউন্সিলিং। অভিজ্ঞ কাউন্সিলরের সাহায্য শিশুমনের জটিলতা কাটিয়ে শিশুকে সঠিক পথে চালিত করতে পারে।

কাউন্সিলিং কেন?

আমি কী চাই? কোন কাজটা ভালো করতে পারি? আমি কেমনভাবে চিন্তা করি? এই প্রশ্নগুলো আমরা নিজেকে করতে শিখিনি। নিজেকে জানা, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া, নিজের বিশ্বাস এবং নৈতিক বোধ সম্বন্ধে গভীর আস্থা থাকা একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের জন্য একান্ত জরুরি। আর এই বীজমন্ত্র শিশুর মনে বপন করা উচিত একদম ছোট বয়স থেকেই। একটি শিশুর গড়ে ওঠার বয়সটাই তার আগামী জীবনের ভিত্তি। সে যখন তার পরিবারকে চিনতে শিখছে, নিষ্পাপ মন নিয়ে চারপাশের মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় করছে, তখনই প্রয়োজন তার তার সঠিক পথনির্দেশনা। আমি কী পারি আর কী পারিনা এই জানাটা খুব জরুরি। সব বাবা-মা সন্তানের ভালো চান। এতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু ভালো চাইতে গিয়ে নিজেদের উচ্চাভিলাষ, অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন না তো? বাবা-মায়ের এই প্রত্যাশার চাপ সন্তানের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা এই চাপ একসময় আর নিতে পারছে না। একজন কাউন্সিলর পারেন একটি শিশুকে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে, পারেন তার আবেগের সমন্বয় করে তাকে ঠিক পথে চালিত করতে।

কখন প্রয়োজন কাউন্সিলিং?

১। শিশুর প্রতিদিনের ব্যবহারে হঠাৎ কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন এলে।

২। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, আপনজনের মৃত্যু, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো দুঃখজনক ঘটনার পর শিশু আতঙ্কিত বা হতাশ হয়ে পড়লে।

৩। কোনো ঘটনায় ভয় পেয়ে অস্বাভাবিক ব্যবহার করলে।

৪। মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়লে।

৫। যৌন হয়রানির শিকার হলে।

বাবা-মায়ের ভূমিকা

১। নিজেরা সুখী থাকুন। সুস্থ, সুন্দর, সুখী পরিবার অনেক সমস্যাই সমাধান করে দেয়। বাবা-মায়ের ভালো সম্পর্ক শিশুকে একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাখে যা তার সার্বিক বিকাশের জন্য সহায়ক।

২। সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠুন। অতিরিক্ত আদর বা শাসন করবেন না। ওর পড়াশোনা, শখ বুঝতে চেষ্টা করুন। নিজেদের প্রত্যাশার বোঝা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। ও যেমন, ওকে সেভাবেই বড় হতে দিন।