এলিয়ান বার্ম ।।
আমাজন বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। এই মুহূর্তে বিশ্বে জলবায়ু ধ্বংসের সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাজন। যদি বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে আমরা এর মোকাবেলাও করতে পারব না। ৫০০ বছর ধরে এটি ধ্বংসযজ্ঞের স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় আক্রমণ সর্বপ্রথম সভ্যতার ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে এসেছিল। তাদের আক্রমণে কয়েক হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং কয়েক ডজন সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছিল।
২০১৯ সালে আমরা নতুন করে একটি বিপর্যয়কর অধ্যায়ের সূচনা করেছি। এ বছর বৃক্ষ নিধনের পরিমাণ বেড়েছে। এই মাসে আমাজনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সম্ভবত অঞ্চলটি সাফ করার জন্য একটি ধ্বংসাত্মক গোষ্ঠী কৌশলে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এখন কেন এমন হচ্ছে? ক্ষমতা পরিবর্তনের কারণে। বলসোনারিজমের নামে রাজনীতির একটি লুণ্ঠনকারী রূপ ব্রাজিলের প্রায় সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। প্রেসিডেন্ট জাইরের প্রধান প্রকল্প হলো পদ্ধতিগতভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে আমাজন বন উজাড় করা। এ কারণেই, ব্রাজিল পুনরায় গণতান্ত্রিক হওয়ার পর পরিবেশবিরোধী একজন মন্ত্রী নিযুক্ত করেছে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো পরিবেশমন্ত্রী রিকার্ডো সেলসের মতো স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করতে পারেননি। তিনি কৃষিজমির জন্য গোফর বনভূমি উজাড়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বনভূমিতে গড়ে ওঠা দালান-কোঠার মালিকানায় ব্রাজিল সরকার সব সময় অংশীদার ছিল। কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে, আবার কখনও অনানুষ্ঠানিকভাবে। তবে আজ এটি একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে। এখন তারা সরকারের অংশ নয়; বরং তারাই সরকার।

বোলসোনারিজমের প্রথম বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সরকারি জমির পরিবর্তে বেসরকারি জমিতে স্থাপন করে সবাইকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। কারণ তারা প্রাকৃতিক বায়ুমণ্ডল সংরক্ষণ, আদিবাসীদের জীবনমান ও পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এতে কিছু মানুষ লাভবানও হয়েছে। এসব জমির অধিকাংশই আমাজন অরণ্যে অবস্থিত। সরকার এসব জমি অধিগ্রহণ করেছে, যদিও এসব জমি ব্যবহারে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। জমিগুলো রিবিইরিনহোসদের (ব্রাজিলের একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী, যারা নদীতীরে বসবাস ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে) থেকে এবং কিলোমবোলাসদের সম্মিলিত ব্যবহারের (বিদ্রোহী দাসদের বংশধর, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের দখলে থাকা জমির অধিকার অর্জন করেছিল) বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সরকারে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কারণ বোলসোনারো প্রশাসন প্রতিটি সম্ভাবনাময় স্থান দখল করার জন্য তার স্ববিরোধী কৌশল নিয়োগ করেছে। তবুও আদিবাসীদের অধিকৃত জমি ও সংরক্ষণের ক্ষেত্র সুগম করতে ঐকমত্য প্রয়োজন। গ্রহের বৃহত্তম গ্রীষ্ফ্মমণ্ডলীয় বনে গবাদি পশু পালন, সয়াবিন বৃদ্ধি ও খনি আহরণের ক্ষেত্রে কোনো যুদ্ধ নেই। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে অসম্পূর্ণ বক্তব্য প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বলসোনারিজম কয়েক দশক ধরে পুরো আমাজন অঞ্চলকে প্রভাবিত করে চলেছে। এটি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র সংকটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বলসোনারিজম কেবল ব্রাজিলের জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ এটি সেই জঙ্গলকে ধ্বংস করছে, যা বৈশ্বিক উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কীভাবে আমরা এই শক্তিশালী ধ্বংসাত্মক শক্তিটি প্রতিহত করব? এদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই বন হয়ে উঠতে হবে এবং বনের মতো প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদের উদ্যোগকে কার্যকরী করতে বিষয়টিকে রাজনৈতিক ও সহনশীলতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এর অর্থ, আমাদেরকে গঠনমূলক চিন্তা করতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।
বিষয় হচ্ছে আমাজনকে এখনও আমাদের পরিধি থেকে অনেক দূরের কিছু হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই বিবেচনাটি বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা কমাতে আমাজনের ভূমিকাকে ছোট করে। বন আমাদের একেবারেই মূল অংশ। এটাই মানবতার মূল আবাস। এর পরও আমরা অনেকে বনকে দূর ভাবি, যা আমাদের চোখকে দূষিত ও বিকৃত করে উপস্থাপন করে মাত্র।
আমরা যে পোশাক পরে থাকি বা আমরা যে খাবার খাই, তার উৎস নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের রয়েছে। তবে আমাজনে আপনি যদি গরুর মাংস খান তবে আপনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, এটি উজাড় করা বন থেকে সংগৃহীত গোমাংস। আপনি যদি কাঠ কিনে থাকেন তবে আপনি জানেন যে ব্রাজিলে (প্রায়) কোনো সত্যিকারের আইনি কাঠ নেই। আপনি যদি কোনো টেবিল বা একটি ওয়ারড্রোব কিনে থাকেন, তবে আপনি আসবাবের দিকে তাকান এবং ভাবেন যে সম্ভবত এগুলো কোনো আদিম জমি থেকে সংগৃহীত কাঠ দ্বারা তৈরি। বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত আমাজন। সেখানে বন ও বনবাসীর মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান।
আমাদের বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করা দরকার, বনের মানুষরা লড়াই সত্ত্বেও কীভাবে আমাদের গ্রহণ করে? তারা ধ্বংসস্তূপেও কীভাবে বাঁচতে জানে? তারাই ধ্বংসাত্মক শক্তিকে প্রতিরোধ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আমাদের যদি প্রতিরোধ করারও সুযোগ থাকে, তবু অবশ্যই বুঝতে হবে, এই লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তি আমরা নই।
বলসোনারো কেবল আমাজনের জন্য হুমকি নয়। তিনি গ্রহের জন্য হুমকি। কারণ তিনি আমাজনের জন্য হুমকি। আমাদেরকে দাসত্ব করা আফ্রিকানদের অনুকরণ করতে হবে, যারা অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আমাদের সবাইকে, সব জাতিকে অবশ্যই বলসোনারিজমের তীব্র ধ্বংসাত্মক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের অবশ্যই ব্রাজিলের পালানো দাসদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের মতো সম্প্রদায় তৈরি করতে হবে। এবং যেহেতু আমরা এটি করতে জানি না, তাই যারা করে তাদের সঙ্গে শেখার জন্য আমাদের যথেষ্ট নম্র হতে হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর- সাইফুল ইসলাম।
You must be logged in to post a comment.