২০২০ সালের মধ্যে দিল্লী, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদের মতো শহরের ভূগর্ভস্ত জল ফুরিয়ে যাবে। জল সঙ্কটে পড়বে ১০-১৫ কোটি ভারতীয়। নীতি আয়োগের রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে পানীয় জলের অভাবে পড়বে ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ। এই ভয়াবহ রিপোর্ট সামনে আসতেই শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম আলোচনা দোষারোপ, চাপানউতোর। একদিকে বেড়ে চলা দাবদাহ আর অপরদিকে জল সঙ্কট, মরুভূমির বালুরাশি কি তবে আমাদের অদূর ভবিষ্যৎ?
আসলে এই ভবিতব্য তো আমাদেরই তৈরি করা একটু একটু করে। চিপকো আন্দোলন, নর্মদা আন্দলনের সময় থেকেই পরিবেশ কর্মীরা ভারতের এই আগামীর ভয়াবহতা নিয়ে সতর্ক করেছেন বারবার। কিন্তু একদিকে বহুজাতিক সংস্থার চাপ আর তার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের দালালি সাধারণ মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে নানাভাবে। ফলে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নদী বাঁধ মৃত্যু ঘটিয়েছে একাধিক নদীর, নষ্ট করেছে প্রাকৃতিক জলের উৎসকে।
আর এরই সঙ্গে চুপিচুপি থাবা বসিয়েছে পুকুর চুরি বা পুকুর ভরাট। গত দশকেও পুকুরগুলো গ্রাম বা শহরে বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ধরে রাখার প্রধান জায়গা ছিল। বর্ষার সময় ছাড়া সেচের কাজে ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য জলের মূল উৎসই ছিল গ্রাম বাংলার এই পুকুরগুলো। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেও এগুলো যে বুঁজিয়ে ফেলা যায়না- এটা সবার জানা থাকলেও একের পর এক ভরাট করা হয়েছে জলাভূমি।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে এমনভাবে এই কাজ করা হয় যাতে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস না পায়। গ্রাম কি শহর সব জায়গাতেই জমি মাফিয়ারা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এক অদ্ভুত আঁতাত তৈরি করে শুধু পুকুর নয় এলাকার প্রাচীন জলাভূমিগুলো ভরাট করে ফেলেছে। কোথাও আবার পরিকল্পিত ভাবে নোংরা, আবর্জনা, অব্যবহৃত ইট, কাঠ, শুকনো ডাল, পাতা ফেলে একটু একটু করে প্রথমে পুকুরের প্রয়োজনীয়তা নষ্ট করে দেওয়া হয়, পরে পঞ্চায়েত বা পুরসভার সাহায্যে পৌর-আবর্জনা ফেলে রাতারাতি ভরাট করে জমির চরিত্র বদলে ফেলা হয়। যেহেতু এখানে ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে এবং অত্যন্ত গোপনীয়তায় এমনকি রাতের অন্ধকারে এই ভরাট হয় তাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আন্দোলন গড়ে ওঠে না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও উদাসীন। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,”পুকুর ও জলাভূমি ভরাট বিষয়টি ভূমি দপ্তর ও মৎস দপ্তরের দেখার বিষয়, আমাদের কিছু করার নেই।”
যদিও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন সিনিয়র ল অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন,”সংবিধানের ২৪ ধারায় এ বিষয়ে বলা আছে, হাইকোর্টও ২৪ ও ২৫ ধারা উল্লেখ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে পরিস্কার নির্দেশ দিয়েছে যে তারাই এই জলাভূমি ভরাট বিষয়টি দেখবে। তারপরও পর্ষদের এই উদাসীনতা, এই আত্মঘাতী মনোভাব দুর্ভাগ্যজনক।”
জলাভূমি নষ্ট হওয়ায় তার প্রভাব যেমন আবহাওয়ায় পড়ছে তেমনি মাটির নীচের জলের উৎস নিঃশেষ হওয়ার অর্থ আমাদের পানীয় জলের সিংহভাগ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তার উপর ঠাণ্ডা পানীয়ের বহুজাতিক সংস্থাগুলি কোটি কোটি লিটার মাটির নীচের জল তুলে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এবার হয়তো ভাবার সময় এসেছে, আমরা কোনপথে এগিয়ে চলেছি…।