মতামত

ইরফানের জীবনের শেষ দুই বছর

জিনাত শারমিন

ইচ্ছে করেই শিরোনামে ‘ইরফান খান’ না লিখে শুধু ইরফান লেখা। ভারতীয় বিনোদন সাংবাদিক রাজীব মাসান্দের সঙ্গে ‘অভিনেতাদের গোলটেবিলে’ বসে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনো “খান” নই। আমি কেবলই ইরফান।’ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জানা গেল, এক রোগ জেঁকে বসেছে ‘কেবলই ইরফানে’র শরীরে। আর সেই রোগের নাম ‘নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার’। এরপরের মাসে অন্তর্জালের দুনিয়ায় ভেসে উঠল এক টুইট।

‘মাঝেমধ্যে জীবন আপনাকে ঝাঁকুনি দিয়ে নাড়িয়ে দেয়। গত ১৫ দিনে আমার জীবনে যা ঘটল, তাতে আমার জীবন একটা সাসপেন্সভরা গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি সব সময় বিরল সব গল্প খুঁজতাম, তাই বোধ হয় জীবন আমাকে বিরল এক রোগের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবে আমি জীবনে কখনোই হাল ছাড়িনি। এবারও ছাড়ব না। আমি যুদ্ধ করব। আমার পরিবার আর কাছের মানুষেরা আমার সঙ্গে আছে। আর আমরা সবাই মিলে কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সে জন্য চেষ্টা করছি। আমার অসুখ, শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে আগাম অনুমান করার দরকার নেই। আমি নিজেই ৭ দিন বা ১০ দিন পরপর পরীক্ষা শেষে পরিস্থিতি জানাব।’

১৫ মার্চ এভাবেই নিজের ক্যানসারের কথা টুইটে জানান দিয়েছিলেন সেই যোদ্ধা। কথা রেখেছিলেন ইরফান। যুদ্ধ করেছিলেন। এক বছর পর মৃত্যুর সঙ্গে দেখা করে একটু স্পর্শ করেই ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিরে এসেছিলেন। সেবার আর মরণকে আলিঙ্গন করা হয়নি। দ্বিতীয় জীবন পেয়েও তিনি অভিনেতাই হয়েছিলেন। ফিরেছিলেন প্রিয় শুটিং সেটে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ইরফান খান টুইটে বললেন, ‘আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। অনেক সময় আমরা ভালোবাসার মূল্য ভুলে যাই, কঠিন সময় আমাদের আবার ভালোবাসা চেনাতে শেখায়। আপনাদের সবার এই ভালোবাসা আমাকে সুস্থ হওয়ার বড় ওষুধ। আমি আবার আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি।’ সেই ফেরা যে ক্ষণিকের, কে জানত!

২০১৯ সালের জুলাই মাসে শেষ হলো ইরফানের শেষ ছবি ‘আংরেজি মিডিয়াম’–এর শুটিং। সেদিন এই ছবির পরিচালক হোমি আদজানিয়া ইনস্টাগ্রামে তাঁর আর ইরফান খানের একটা ছবি পোস্ট করলেন। ইরফান একটা শিশুর মতোই জড়িয়ে ধরে আছে তাঁকে। যেন খুব দুঃখের কিছু ঘটেছে ইরফান খানের জীবনে। তাই তিনি জড়িয়ে ধরেছেন নিজের সবচেয়ে আপন মানুষটাকে, যাতে দুঃখ কিছুটা ঝরে পড়ে, লাঘব হয়। মহাকালের কোথায় তাকিয়ে কী দেখছেন, কী ভাবছেন কে জানে! ছবিটি প্রকাশ করে হোমি লিখলেন ইরফান খানকে নিয়ে তাঁর অনুভূতিকাব্য। সেই কাব্যের শব্দে, বাক্যে আর শব্দ, বাক্যের ফাঁকে ফাঁকে বিরতিতে ছিল ইরফান খানে মুগ্ধ, বিস্মিত এক মানুষের ভালোবাসা। না, এবার হোমি আদজানিয়া ইরফান খানের পরিচালক নন। তিনি কেবলই একজন সাধারণ মানুষ, যার সঙ্গে একজীবনে দেখা হয়েছিল ইরফান খানের। তিন মাস তাঁরা একই যাত্রায়, একই পথে একসঙ্গে হেঁটেছেন।

হোমি আদজানিয়া ছবিটির ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘ইরফান খান, মানুষ হিসেবে তুমি অবিশ্বাস্য। অভিনেতা হিসেবে তুমি “পারফেক্ট”। আমি কীভাবে বলি, মানুষ হিসেবে তোমাকে কতটা ভালোবাসি। আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি বানাতে চেয়েছিলাম। আমি জানি, ছবি বানানোর সেই কারণগুলো ভুল। কিন্তু এরপরও মনে হচ্ছে, সবই ঠিক আছে। কারণ, এখানে একজন ছিলেন, যিনি ইরফান খান। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সম্মিলিত শুভবোধ আর জীবনকে উদ্‌যাপন করার মধ্য দিয়েই এটা হলো। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই ছবি আমাকে শিখিয়েছে, কীভাবে জীবনকে আরও আলোকিতভাবে দেখা যায়। আমি আমার সারাটা জীবন ধরে কেবল এটাই চেয়েছি।’

শেষ ছবির প্রচারণায় অংশ নিতে পারেননি ইরফান। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ‘আংরেজি মিডিয়াম’ ছবিটি মুক্তির আগ দিয়ে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন ইরফান। সেটিকে একটুও পরিবর্তন না করে সিনেমার ট্রেইলারের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে প্রকাশ করলেন পরিচালক। শোনা গেল, ইরফান বলছেন, তিনি দর্শকদের সঙ্গে আছেন, আবার নেই। চেয়েছিলেন ছবিটি যতটা যত্ন নিয়ে বানানো, ততটাই আন্তরিকতার সঙ্গে ছবির প্রচারণায় অংশ নিতে। কিন্তু তাঁর শরীরে কিছু অযাচিত মেহমান এসে পড়েছে। তাই তাদেরকে সঙ্গ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

কথায় বলে, জীবন আপনাকে লেবু দিলে শরবত বানিয়ে খান। ইরফান বললেন, এই প্রবাদটা যত সহজে বলা হয়েছে, জীবনে এর প্রয়োগ করা তত সহজ নয়। ‘সবাই সবার প্রতি দয়ালু হোন। আর আমার জন্য অপেক্ষা করুন।’ এই ছিল মিডিয়ায় ইরফানের শেষ কথা। কিন্তু সেই অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোয়নি। তার আগেই বিদায় বলেছেন জাদুকরি এই অভিনেতা।

‘আংরেজি মিডিয়াম’ নামের সেই ছবি মুক্তি পেল বন্দীর দিনে। তাই বক্স অফিসের রমরমা ব্যবসা না হলেও বরাবরের মতোই ইরফানের চোখের গভীরতায় ডুব দিল দর্শক। কিন্তু এই শেষবার। এরপরই সব বিগড়ে গেল। মা মারা গেল ইরফানের। শেষ দেখা হলো না। দূর থেকে ভিডিও কলে দেখলেন মায়ের দাফন। আর চার দিনের মধ্যে চলে গেলেন মায়ের কাছে।

সবাই বাঁচতে চায়। বাঁচতে চেয়েছিলেন ইরফান খানও। স্ত্রী সুতপা সিকদারের জন্য, দুই ছেলে বাবিল, আয়ানদের জন্য। দিনশেষে পরিবারই ছিল তাঁর সবকিছু। সুতপাই জানিয়েছিল, ইরফান নাকি ঘরে ফিরে চিত্রনাট্য নিয়ে সোজা তাঁর শোবার ঘরে চলে যেতেন। মেঝেতে বসে পড়তেন। আর স্ত্রী–সন্তানেরা তাঁর আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করত, গল্প করত। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে মুম্বাই মিররকে ইরফান বলেছিল, ‘সে (স্ত্রী সুতপা শিকদার) আমাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য কী না করেছে! আমি ওর জন্য বাঁচতে চাই। আমি যতটা যা এগিয়েছি, কুড়িয়েছি—সবকিছুই এই মানুষটার জন্য সম্ভব হয়েছে।’

তখন ‘আংরেজি মিডিয়াম’–এর শুটিং চলছিল। আর ইরফানের শরীরের কোষে কোষে চলছিল সুস্থ হয়ে ওঠার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। সেই সময় এক সাক্ষাৎকারে ইরফান খান নিজের জীবন, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই, বেঁচে থাকা নিয়ে বলেছিলেন, ‘যতটা কেঁদেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি হেসেছি। কত কিছু ঘটল একজীবনে! জীবনটা যেন রোলারকোস্টারে চড়ে পার করে দিলাম। নাম করলাম। জীবনে অনিশ্চয়তা থাকে বলেই ভালো সময়গুলো আমরা মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রাখি। জীবন যেন প্রতিনিয়ত হপস্কচ (বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যাকে বলে কুতকুত) খেলা।’

ইরফান বলেছিলেন, জীবন মানে কেবলই চলে যেতে দেওয়া। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই, সেই চলে যাওয়ার আগে বিদায় বলা হয়ে ওঠে না। বলেছিলেন, জীবন এত কিছু দেয়, এরপর আমরা সেই জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে একটু থেমে, পেছনে ফিরে গিয়ে সেই জীবনে জড়িয়ে ধরে একবার ‘থ্যাংক ইউ’ বলার ফুরসত মেলে না। জীবনকে ‘ধন্যবাদ’ দিয়েছিলেন কি না কে জানে, বিদায় না বলেই চলে গেলেন না–ফেরার দেশে।