আকতার হোসেন
ঠিক এক সপ্তাহ আগে চিত্রনির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের `সীমান্তরেখা’ দেখছিলাম। দেখলাম বাংলা ভাগ নিয়ে দুই দেশের দুইজন সাহিত্যিক ড. আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়ের বক্তব্য। বাংলা ভাগ কেন এবং এর ফলে লাভক্ষতি কার? এসব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত অথচ কংক্রিট উত্তর দিয়েছিলেন তারা, যা জীবন বাস্তবতায় হৃদয়গ্রাহী ও যৌক্তিক মনে হয়েছিল। সেটি লিখেও রেখেছিলাম। অবশ্য লিখে রাখার কারণ ভিন্ন। জন্মভূমি ছেড়ে আসা মানুষগুলোর আবেগ ও অনুভূতি সবসময়ই হৃদয়কে স্পর্শ করে। তাদের রক্তের ভেতরে গোপন কান্না ও অভিব্যাক্তিকে ধারণ করবার চেষ্টা করা। যদিও সে চেষ্টা বৃথা। বিষয়টি সহজও নয়। এক একটি উদ্বাস্তু ক্যাম্প, ঘরহারা এক একটি মানুষ, এক একটি আলাদা গল্প। এক একটি আলাদা ইতিহাস। ২০২০ সালে বসে ৭৩ বছর আগের ঘটনাকে আসলে কতটুকু স্পর্শ করা যায়?
‘সীমান্তরেখা’ দেখার সময় একটুও কি ভেবেছিলাম ঠিক এক সপ্তাহ পরই এই দুই বড় মানুষের মৃত্যু হবে এবং একই দিনে। গত ১৪ মে বৃৃহস্পতিবার বিকেলে মারা গেলেন ড. আনিসুজ্জামান। একইদিন রাতে মারা গেলেন দেবেশ রায়। মৃত্যুকালে দেবেশ রায়ের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। আনিসুজ্জামানের বয়স ৮৩ বছর। মূলত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের বহু সাক্ষাৎকার ও ধারাভাষ্যের ওপর ভিত্তি করেই ‘সীমান্তরেখা’ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে ঐতিহাসিক ফুটেজ। উদ্বাস্তু কলোনি ও দুই বাংলার মানুষের হারানো ভিটেমাটির বর্তমান চিত্রও উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে।
আমার জানা মতে, বাংলা ভাগ নিয়ে এমন বড় আয়োজনে একটি ডকুমেন্টারি এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো নির্মাতা তৈরি করেননি। দেশভাগের ৭০ বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর আগে ১৯৯৮ সালে তানভীর মোকাম্মেল দেশভাগ নিয়ে কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেন ‘চিত্রা নদীর পারে’। তানভীর মোকাম্মেলের ব্যক্তিজীবনেও রয়েছে দেশভাগের প্রভাব। তার মায়ের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। নানার কবরও সেখানে। পাকিস্তান আমলে বাবার কবর দেখতে যেতে না পারার কারণে মাকে কাঁদতে দেখেছেন তানভীর মোকাম্মেল। মানবতার এমন বিপর্যয়, কোটি কোটি মানুষের এমন মাইগ্রেশন পৃথিবীর মানুষ এর আগে আর দেখেনি। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের ফলে ভারত থেকে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ৫৮ লাখ হিন্দু ভারতে দেশান্তরী হন। দেশভাগের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন প্রায় ৫ লাখ মানুষ। কারও কারও মতে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
পশ্চিমবাংলায় জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষাবিদ ও লেখক আনিসুজ্জামান। দেশভাগের সময় পাড়ি জমান পূর্ব বাংলায়। কেন এই দেশভাগ? সীমান্তরেখা’র প্রামাণ্যচিত্রে তিনি বলেন, ‘চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে বঙ্গপ্রদেশে হিন্দু-মুসলমানের একযোগে কাজ করার সম্ভাবনা ক্রমশ কমতে থাকে। ১৯৩৭ এর নির্বাচনে ফজলুল হক যে জিতলেন, উনি কংগ্রসের সঙ্গে মিলেই তো মন্ত্রিসভা করতে চেয়েছিলেন, কংগ্রেস রাজি হয়নি। ফলে মুসলিম লীগের সঙ্গে করলেন এবং একসময় মুসলিম লীগে যোগও দিলেন। এই যে রাজনীতির পথটা ক্রমশ আলাদা হয়ে যেতে থাকলো। তার চরমমুহূর্ত হচ্ছে ৪৬ এর দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পর দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
‘আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), পুরনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), কাল নিরবধি (২০০৩), বিপুলা পৃথিবী। পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। যুক্ত বাংলা কেন হলো না?
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ৪৭ এ ভারতভাগ হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবিভাগকে রোধ করার একটা চেষ্টা হয়েছিল, সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু মিলে। কংগ্রেসসহ দুই দলের হাইকমান্ড তা অগ্রাহ্য করলো। হিন্দু মহাসভা বড় ভুমিকা পালন করলো বঙ্গপ্রদেশ ভাগ করার জন্যে, কংগ্রেস তার সঙ্গে গেলো। ফলে এটা রোধ করার কোন উপায় ছিল না।’ ৮০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ড আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করিনি। তবে এই মাটিই যেন আমার শেষ আশ্রয় হয়, এই আমার অন্তিম প্রার্থনা।’ শুক্রবার সকালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরেই তাকে দাফন করা হয়।
ভারতের বিখ্যাত লেখক দেবেশ রায়ের জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। দেশভাগের আগেই ১৯৪৩ সালে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ভারতের জলপাইগুড়ি চলে যান। সাহিত্যে তার যাত্রা শুরু ‘যযাতি’ উপন্যাস দিয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যসৃষ্টি হলো উদ্বাস্তু, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, মফস্বলী বৃত্তান্ত, বরিশালের যোগেন মন্ডল, তিস্তাপুরাণ, নিরস্ত্রীকরণ কেন, মানুষ খুন করে কেন, কলকাতা ও গোপাল, শরীরের সর্বস্বতা। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের জন্য ১৯৯০ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। দেশভাগ প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল এই মানুষটিকে। ‘জন্ম-প্রজন্মে’ এক তরুণের আকস্মিক দুঃসাহসিক প্রশ্ন ‘কী বদলেছেন?…যুদ্ধ নেই, অথচ মৃত্যু আছে, দাঙ্গা নেই অথচ খুন আছে, দেশভাগ নেই, অথচ উদ্বাস্তু আছে, দুর্ভিক্ষ নেই, অথচ লোকে না খেতে পেয়ে মারা যায়।…আপনাদের ইতিহাস ভাঙিয়ে আপনারা ত বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের তো কোনো ইতিহাসও নেই।’
তবে দেশভাগের ফলে কার ক্ষতি কার লাভ স্পষ্ট করেই তুলে ধরেন তিনি- ‘এটা তো ঐতিহাসিক সত্য বাঙালি হিন্দু কংগ্রেসের নেতারা, হিন্দু মহাসভার নেতারা পশ্চিমবঙ্গের একটা অংশকে টুকরো করে নিতে চাইছিলেন যে টুকরোটায় হিন্দুরা নিরাপত্তায় থাকবে। যদি বলেন, দেশভাগের ফলে লাভ হলো কার? আমি নিশ্চিতভাবে বলবো বাঙালি মুসলমান সমাজের।’ সীমান্তরেখা প্রামাণ্যচিত্রে তিনি এক মহাসত্যকেও উপস্থাপন করেছেন, বলেন, ‘বাঙালির জীবনে একটা প্রশ্ন অমিমাংসিত থাকলো, সেটি হচ্ছে হিন্দু মুসলিম এই যে দুটি ধর্মীয় সমাজ নিয়ে এতো বছর ধরে আছে, তার নিজস্ব গতিবেগ নিয়ে, তার নিজস্ব উত্তেজনা নিয়ে, উদ্বেগ নিয়ে, তার কোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিরসন হলো না, হলো একটা রাজনৈতিক নিরসন।’
এভাবেই ক্ষতবিক্ষত মানুষের তিক্ত জীবন অভিজ্ঞতা, ঘরহারা মানুষের হাহাকার, গোপন কান্না, অতীতের শৈশবে বারবার ফিরে যাওয়ার অদম্য আকুতিকেই যেন স্পর্শ করে তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রনির্মাণের বিষয়বক্তব্য। দেশভাগ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি যেন ঋত্বিক কুমার ঘটকেরই আবেগময় উত্তরাধিকার। ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলোতে ঘরহারা মানুষের হাহাকারই প্রধান বিষয়। শেকড়ের টানে ঋত্বিক একে একে নির্মাণ করেছেন মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণ রেখা। তাঁর নির্মিত ৮টি চলচ্চিত্রের মধ্যে তিনটিরই বিষয়বস্তু দেশভাগের শিকার হওয়া মানুষের জীবন ও মৃত্যু।
ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলোর মধ্যে দুই বাংলার মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত মেঘে ঢাকা তারা। তাতে আমরা কী দেখলাম? একটি জীবনের বিনিময়ে একটি উদ্বাস্তু পরিবারের পুনর্বাসনের কাহিনী। সে জন্য ক্ষোভ, কষ্ট ও যন্ত্রণাকাতর বৃদ্ধ পিতার উত্তোলিত তর্জনী- ‘I accuse’। মানুষের বিপন্ন জীবনের জন্য কাকে দায়ী করছেন এই বৃদ্ধ?
তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র পূর্ব পাকিস্তানের নড়াইলের বাসিন্দা উকিল শশীভূষণ সেনগুপ্ত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ট্র্যাজেডির শিকার হয়ে আক্ষেপে বলে উঠেন ‘দেশে মাইনোরিটির সমস্যা কি জানো, তাদের কোন নেতা নেই।’ এই ছবিতে বাম নেতার কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়,’ বর্ডারের এপার কও আর ওপার কও মাইনোরিটির অবস্থা পৃথিবীর কোথাও ভালো না।’
তবুও বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীর পারে তাদের বসতভিটা হওয়ায় এ যেন একখণ্ড স্বর্গ। তাই শশীভূষণের মেয়ে মিনতি বলে উঠে, ‘আমরা কোথাও যাবো না কাকাবাবু।’ তারপরও পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে তাদের চলে যেতে হয় শেকড় ছেড়ে, জন্মভূমি ছেড়ে। পেছনে থাকে শুধুই স্মৃতি।
ছিন্নমূল মানুষের স্মৃতিগুলোকে এতবছর পর আবার সামনে তুলে এনেছেন নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল তার সীমান্তরেখা’য়। দুই ঘণ্টা ২৪ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্র তাই হয়ে উঠেছে ঘরহারা মানুষের কষ্টকাব্য। যে কষ্টকাব্যের সাক্ষ্য হয়ে থাকলেন ড. আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়। হয়তো একই দিনে মৃত্যু সে কারণেই। তাঁরা দুজনই যে জন্মভূমিহারা।
লেখক : সাংবাদিক, ঢাকা।